আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর দেশে প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনে দেখা যায় আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সের মানুষের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। ঋতু বদলের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস, সর্দি-জ্বরের মতো মৌসুমি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। এমন অবস্থায় সকলকে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিন ও রাতের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে ঠাণ্ডাজনিত রোগ বাড়ছে। প্রতিটি বিভাগীয় হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ উপজেলার হাসপাতালেও আবহওয়া পরিবর্তনজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু রোগীদের প্রচুর ভিড় দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ করেই মানুষ সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। থাকছে মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, হাঁচির মতো লক্ষণ। কারও কারও কাঁপুনি নিয়ে জ্বর মারাত্মক আকার ধারণ করছে। শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দিচ্ছে। ডায়রিয়াসহ অ্যাজমা রোগীরা বেশি ভুক্তভোগী বলে জানা গেছে।
আবহওয়ার পরিবর্তনের সময় ফ্লু এর প্রকোপ বাড়ে। এবারও বেড়েছে। সতর্ক থাকার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এসময়টাই ফলমূলসহ গরম খাবার বেশি খেতে হবে। শরীরে শক্তি যোগায় এমন খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। আর জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ঋতুর পরিবর্তন মূলত একটা উপলক্ষ। এ সময় নানা জীবাণুর আক্রমণ ও পরিবেশের পরিবর্তনজনিত কারণেই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয় যার সঙ্গে আমাদের শরীর ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না। তাই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি যা আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। চলুন জেনে নিই এজন্য আমাদের করনীয় কী কী।
সঠিক খাদ্যাভ্যাসঃ ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবারের জুড়ি নেই। তাজা ফলমূল, শাকসবজি, এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত। ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, কমলা, পেয়ারা এবং আপেল খেলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। বর্ষার এই সময়টাতে বাজারে অনেক শাক উঠতে দেখা যায়। অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে, সিদ্ধ করে এরপরেই খাওয়া উচিত। নাহলে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের আক্রমণের আশংকা থেকেই যায়। পর্যাপ্ত পানি পান করতে ভুলে গেলে চলবে না, যাতে শরীরে পানিশূন্যতা না ঘটে এবং শরীর সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। চলুন এজন্য আমাদের কী কী করনীয় রয়েছে।
পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামঃ অন্য যেকোনো সময়ের মতো ঋতু পরিবর্তনের সময়ও পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম খুবই জরুরি। ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। বড়দের ক্ষেত্রে দিনে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘুমের সময় শরীরের হরমোনগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যা শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামঃ সুস্থ এবং সক্রিয় থাকতে নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে এবং মানসিক চাপ কমায়। ঋতু পরিবর্তনের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটাহাঁটি করা, ইয়োগা করা অথবা হালকা ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করা যেতে পারে।
ঋতু অনুযায়ী পোশাক পরাঃ শীতের শুরুতে বা গ্রীষ্মের প্রখর তাপমাত্রার সময় সঠিক পোশাক পরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শীতে গরম কাপড় পরতে হবে এবং ত্বককে শুষ্ক হওয়া থেকে রক্ষা করতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে, গ্রীষ্মে হালকা এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত, যাতে শরীর সহজে বাতাসের আনাগোনা হতে পারে।
ঠান্ডা লাগলে করণীয়ঃ সর্দি-কাশি যদি লেগেই যায়, তখন এর থেকে রেহাই পেতে কিছু কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং প্রচুর পানি পান করুন যা শরীরকে আর্দ্র রাখতে এবং সর্দি, কফ পাতলা করতে সহায়ক। গরম পানীয়, যেমন, আদা চা বা মধু মেশানো গরম পানি, গলা নরম করে এবং কাশি কমায়। লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা গলা ব্যথা এবং জীবাণু দূর করতে টনিকের মতো কাজ করে। গরম বাষ্প নিশ্বাসে টেনে নিলে নাক পরিষ্কার হয় এবং শ্বাস নিতে সুবিধা হয়। আদা, মধু, এবং লেবুর চা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি হিসেবে কাজ করে, যা সর্দি-কাশি কমায়।
এছাড়া, ভিটামিন সি এবং জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যদি সর্দি-কাশি একমাসের বেশি স্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পর্যাপ্ত সূর্যালোক গ্রহণঃ শীত ও বর্ষায় সূর্যের আলো কম পাওয়া যায়, তাই শীতকালে যতটা সম্ভব সূর্যের আলোতে কিছু সময় কাটানো উচিত। বৃষ্টির মৌসুমে ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা দরকার। সূর্যের আলো শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি সরবরাহ করে, যা হাড়ের জন্য উপকারী এবং মেজাজ উন্নত করতে সহায়ক।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াঃ ঋতু পরিবর্তন কেবল শারীরিক নয়, মানসিক চাপও সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের আচরণগত পরিবর্তন হয় যা মানসিক চাপ বা অবসাদের দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই ঋতু পরিবর্তনের সময় নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া উচিত। মেডিটেশন, ভালো বই পড়া ও প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করে।
এভাবেই একটু নিয়ম করে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ব্যায়াম, পরিচ্ছন্নতা, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া, এই সব কিছু মেনে চললে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে সুস্থ থাকা সম্ভব।
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম