অবশেষে পাওয়া গেল গাজা শহরে নিখোঁজ হওয়া ছয় বছর বয়সি শিশু হিন্দ রজবের খোঁজ। তবে জীবিত নয়, পাওয়া গেল তার নিথর দেহ। তার বেশ কয়েকজন আত্মীয় এবং দুজন প্যারামেডিক যারা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, তারাও ইসরায়েলি ট্যাংকের গুলির মুখে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত সোমবার সকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী লোকজনকে শহরের পশ্চিমাঞ্চল খালি করে উপকূলীয় সড়ক ধরে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছিল। খালি করার আদেশে সেদিন রজব তার চাচা, খালা এবং পাঁচ চাচাতো ভাইকে নিয়ে তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
পরিবারের বাকি সদস্যরা ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে মারা গেলেও গাজা শহরে যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে আটকে ছিল হিন্দ রজব। চাচার গাড়ির ভেতর আটকে থাকা হিন্দ অনবরত সাহায্য চাইছিল রেড ক্রিসেন্ট কর্মীদের কাছে। ছোট্ট শিশুটি গাড়িতে বসেই ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জরুরি নম্বরে ফোন দিয়ে তাকে বাঁচাতে আকুতি জানায়। বলে, ‘আমি খুব ভয় পাচ্ছি। দয়া করে তোমরা আসো।’ ফোন লাইনটি যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন সেখানে গুলির ভয়াবহ শব্দ হচ্ছিল।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে যাওয়া পিআরসিএসের দুই প্যারামেডিক ইসরায়েলি হামলার নিহত হন।
হিন্দ ও জরুরি কল অপারেটরের মধ্যকার অডিও কথোপকথনের তথ্য অনুযায়ী, হিন্দ ওই সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গাড়িতে থাকা স্বজনদের মৃতদেহের মাঝে লুকিয়ে ছিল।
গতকাল শনিবার ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির প্যারামেডিকস সে এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এত দিন না পারার কারণ সেই এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলার কারণে সেখানে ঢুকতে পারছিলেন না। তারা সেখানে যাওয়ার পর হিন্দ যে কালো রঙের সেডান কারে ছিল, সেটি দেখতে পান। এটির উইন্ডশিল্ড ও ড্যাসবোর্ড টুকরা টুকরা হয়ে পড়ে ছিল। গাড়িটিতে অনেক গুলির চিহ্ন ছিল।
উদ্ধারকর্মীদের একজন বলেন, গাড়ির ভেতর থাকা ছয়টি মৃতদেহের একটি হিন্দের। এই গাড়িটির কয়েক মিটার দূরে ছিল আরেকটি পুড়ে যাওয়া গাড়ি। এটি উল্টে পড়ে ছিল। রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, হিন্দকে উদ্ধার অভিযানে যে অ্যাম্বুলেন্সটি পাঠানো হয়েছিল, এটি সেই অ্যাম্বুলেন্সের ধ্বংসাবশেষ।
এক বিবৃতিতে, পিআরসিএস ২৯ জানুয়ারি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর সাথে সাথে ইসরায়েলকে ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যাম্বুলেন্সটিকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় এর ক্রু ইউসুফ আল-জেইনো ও আহমেদ আল-মাধুন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
পিআরসিএসের মুখপাত্র নিবাল ফারসাখ বলেন, আমরা ইসরায়েলি বাহিনীর কাছ থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর সবুজ সংকেত পেয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পরে ক্রুরা হিন্দ রজবের গাড়িটি খুঁজে পেয়েছেন বলে জানান। গাড়ির ভেতরে দেখা যাচ্ছিল হিন্দের দেহ।
কল অপারেটরদের সাথে হিন্দের কথোপকথনের রেকর্ডিং রেড ক্রিসেন্ট দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছিল, তার সাথে কী ঘটেছে তা খুঁজে বের করার জন্য।
হিন্দের মা উইসাম, গাজা ও এর জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সহযোগিতার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, কোথায় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত? প্রেসিডেন্টরা তাদের চেয়ারে বসে আছেন কেন?
উইসাম আরো বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তি যারা আমার কণ্ঠস্বর শুনেছেন এবং আমার মেয়ের মিনতি কণ্ঠস্বর শুনেছেন, তবুও তাকে উদ্ধার করতে পারেননি, বিচারের দিন আমি তাদের সৃষ্টিকর্তার সামনে প্রশ্ন করব।
যে হাসপাতালে তিনি তার মেয়ের খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেখানে হিন্দের মা উইসাম এখনো তার জন্য রাখা ছোট্ট গোলাপি ব্যাগটি ধরে রেখেছেন। ব্যাগের ভেতরে একটি নোটবুক ছিল যেখানে হিন্দ তার হাতের লেখা অনুশীলন করত।
সেদিনের অভিযান এবং রজব সম্পর্কে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তারা জানায় তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
শনিবার ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের করা অভিযোগের বিষয়ে আবারও তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসা কর্মীদের অবশ্যই সুরক্ষা প্রদান করতে হবে এবং আহত ব্যক্তিদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে সংঘর্ষের লক্ষ্যবস্তু করা যাবে না। কিন্তু এরপরও ইসরায়েলি বাহিনী ছয় বছর বয়সি হিন্দ রজব এবং তাকে উদ্ধার করতে আসা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে।
এ নিয়ে ইসরায়েল আগে অভিযোগ করেছিল, হামাস তাদের অস্ত্র ও যোদ্ধা পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করছে।
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম