আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে ঠিক কী হয়, তা শ্রীলঙ্কাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। তীব্র এই সংকট এবং এর জেরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গোটা বিশ্বের সামনে শ্রীলঙ্কাকে একটা উদাহরণ হিসাবে সামনে নিয়ে এসেছে। আর এবার শ্রীলঙ্কার পর ১২টি দেশ এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। গত শনিবার (১৬ জুলাই) এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এই তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে মূলত বিপর্যয়ের খাদের কিনারায় থাকা দেশগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার দিকটিকে সামনে আনা হয়েছে। এসব দেশের বৈদেশিক ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যা ভবিষ্যতের চরম সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, মিশর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, ইকুয়েডরসহ তালিকায় আরো রয়েছে বেলারুশ, নাইজেরিয়া, পাকিস্তানের মতো দেশ। ক্রমবর্ধমান ঋণের খরচ, মুদ্রাস্ফীতি এবং ঋণ সবই এসব দেশের অর্থনৈতিক পতনের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে এসব দেশের ঋণের বোঝার পরিমাণ প্রায় ৪০০ বিলিয়ন বা ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে এসব দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণের বোঝা বহন করছে আর্জেন্টিনা। দেশটিকে ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া তালিকায় দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির পরই আছে ইকুয়েডর ও মিশর। এই দেশ দু’টিকেও চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো হচ্ছেঃ
আর্জেন্টিনাঃ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসো এখন কালোবাজারে প্রায় ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। দেশটির রিজার্ভ এখন ভয়াবহভাবে কমে গেছে এবং ডলারের মাত্র ২০ সেন্টে বন্ড বাণিজ্য হচ্ছে। যা ২০২০ সালে দেশটিতে ঋণ পুনর্গঠনের পরের অবস্থান থেকে অর্ধেকেরও কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত পরিষেবা চালিয়ে নেওয়ার মতো আর্জেন্টিনার সরকারের কাছে কোনো উল্লেখযোগ্য ঋণ নেই। তবে ওই সময়ের পরে এটি আরও বাড়তে পারে।
ইউক্রেনঃ টানা প্রায় পাঁচ মাস ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ এই আগ্রাসনের কারণে দেশটিকে অবশ্যই তাদের দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে বলে সতর্ক করেছেন মর্গ্যান স্ট্যানলি এবং আমুন্ডির মতো হেভিওয়েট বিনিয়োগকারীরা। রয়টার্স এর প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনকে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ শোধ করতে হবে এবং তখনই সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অবশ্য বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাহায্যের অর্থ এবং রিজার্ভ দিয়ে কিয়েভ হয়তো এই অর্থ পরিশোধ করতে পারে।
তিউনিসিয়াঃ আফ্রিকায় আইএমএফের কাছে যাওয়া দেশগুলির একটি ক্লাস্টার রয়েছে তবে তিউনিসিয়াকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। রয়টার্স এর প্রতিবেদন বলছে, প্রায় ১০ শতাংশ বাজেট ঘাটতি, বিশ্বের সর্বোচ্চ পাবলিক সেক্টরের মজুরি বিলগুলির মধ্যে একটি এবং এমন উদ্বেগ রয়েছে যে রাষ্ট্রপতি কাইস সাইদ ক্ষমতার উপর তার দখলকে শক্তিশালী করার জন্য চাপের কারণে একটি IMF প্রোগ্রাম সুরক্ষিত করা বা অন্তত মেনে চলা কঠিন হতে পারে। দেশটির শ্রমিক ইউনিয়ন বেশ শক্তিশালী হওয়ায় আইএমএফ-এর প্রকল্পগুলো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ঘানাঃ বিশাল ঋণের বোঝার ফলে ঘানার ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর মুদ্রা এই বছর তার মূল্যের প্রায় এক চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং এটি ইতিমধ্যেই ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য অর্ধেকের বেশি ট্যাক্স রাজস্ব ব্যয় করছে। মূল্যস্ফীতিও প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
মিশরঃ ঘানার মতো মিশরের প্রায় ৯৫ শতাংশ ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত রয়েছে এবং এই বছর আন্তর্জাতিক নগদ অর্থের সবচেয়ে বড় বহির্গমন হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুসারে সেই সংখ্যাটা ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফান্ড ফার্ম এফআইএম পার্টনার্স অনুমান করে যে মিশরের কাছে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হার্ড কারেন্সি ঋণ রয়েছে যা আগামী পাঁচ বছরে পরিশোধ করতে হবে। আর যার মধ্যে ২০২৪ সালে একটি মাংসল ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বন্ড রয়েছে।
কেনিয়াঃ কেনিয়ার রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ সুদ ফিরাতেই ব্যায় করে। এর বন্ডগুলির মূল্য প্রায় অর্ধেক হয়েছে। বর্তমানের পুঁজির বাজারে কোনও যোগাযোগ নেই কেনিয়ার সঙ্গে। ২০২৪ সালে বড় সমস্যার মুখে পড়তে পারে দেশটি।
ইথিওপিয়াঃ G20 কমন ফ্রেমওয়ার্ক প্রোগ্রামের অধীনে ঋণ ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে এই দেশটি। দেশের চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে অগ্রগতি থমকে গেছে। তবে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অগ্রগতি থমকে গেলেও দেশটি তাদের ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ড পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছে।
এল সালভেদরঃ বিটকয়েনকে আইনি বৈধতা দেওয়ার পর এল সালভেদরের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আশার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির ওপর মানুষের ভরসা এমন পর্যায়ে নেমে গেছে যে, দেশটিতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে পূর্ণ হতে যাওয়া ৮০ কোটি মার্কিন ডলারের বন্ড ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্টে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন বন্ড বিক্রি হচ্ছে ৭০ শতাংশ ডিসকাউন্টে।
পাকিস্তানঃ পাকিস্তানের রাজস্ব আদায়ের ৪০ শতাংশ ঋণের সুদ দিতেই খরচ হয়ে যায়। ফলে শেহবাজ শরীফের নতুন সরকারকে খরচ কমাতে হবে। অবশ্য পাকিস্তান চলতি সপ্তাহে আইএমএফের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছে। ইতিমধ্যেই শক্তি আমদানি না করতে পারলে সংকট আরও বাড়বে। এই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯.৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। নতুন সরকার ব্যায় কমাতে চাইছে।
বেলারুশঃ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে গত মাসে রাশিয়াকে ডিফল্টারের পরিণত করেছিল। ইউক্রেন অভিযানে মস্কোর পাশে থাকার জন্য বেলারুশের অবস্থা শোচনীয়।
ইকুয়েডরঃ লাতিন আমেরিকার এই দেশটি মাত্র দুই বছর আগে ঋণ খেলাপি হয়েছিল। কিন্তু হিংসাত্মক বিক্ষোভ এবং প্রেসিডেন্ট গুইলারমো লাসোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টার কারণে এটি আবার সংকটে পড়ে গেছে।
নাইজেরিয়াঃ বন্ড স্প্রেড মাত্র ১০০ বেসিস এর বেশি কিন্তু নাইজেরিয়ার পরবর্তী ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বন্ড পেমেন্ট এক বছরের সময়ের মধ্যে সহজে রিজার্ভ দ্বারা আচ্ছাদিত করা উচিত যা জুন থেকে ক্রমাগত উন্নতি করছে। যদিও এটি সরকারী রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ তার ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় করে।