মো. কামরুজ্জামান, নেত্রকোণা জেলা প্রতিনিধিঃ নেত্রকোণায় অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা সৃষ্টি হওয়ায় মৎস্য খামারগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেয়ে পুকুর থেকে বেরিয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার নানা প্রজাতির মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্য খামার ঘিরে গড়ে ওঠা কলা বাগান, সবজি বাগানেরও।
বন্যার কারণে নেত্রকোণায় মোট ২৬হাজার ৪১৭টি পুকুর, দীঘি, মৎস্য খামারের সম্পুর্ণ মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। মৎস্য চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। কোন কোন খামারী ব্যাংক সহ বিভিন্ন পর্যায়ে ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেছিল। স্বপ্ন বোনছিলো তাদের উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে এবং তাদের সমস্ত ঋণ শোধ হবে। কিন্তু আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ভেসে গেছে তাদের স্বপ্ন। কারো কারো স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। নিজেদের বসতঘরেও উঠেছিল পানি। বর্তমানে পানি নেমে গেলেও এর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে মৎস্য চাষীরা। এর মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ঝুলে আছে ব্যাংক ঋণ। তারা এখন দিশেহারা। বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে এই ঋণ শোধ করবেন।
নেত্রকোণা বারহাট্টা উপজেলার সাহতা ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে নিপা এগ্রো ফিশারিজের স্বত্বাধিকারী মোঃ রোকনুজ্জামান খান খোকনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তিনি ৭০ কাটা পুকুরে পাবদা, তেলাপিয়া, শিং, রুই, কাতল সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করেছিলেন। মাছ প্রায় বিক্রির উপযোগী হয়ে উঠেছিল। বিক্রি শুরু হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। আশা করছিলেন প্রায় ৩০লক্ষ টাকার মাছ ও পোনা বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু বিধিবাম, এর আগেই আকস্মিক বন্যায় সব মাছ ভেসে গেছে। পুকুরের চারপাশে কলা ও সবজি চাষ করেছিলেন। সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন ১২ লক্ষ টাকা। ভেবেছিলেন মাছ উঠিয়ে বাজারে বিক্রি করে ঋণ শোধ করবেন কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এখন ভেবে পাচ্ছেন না কিভাবে এই ঋণ শোধ করবেন।
আরো দু’জন মৎস্য খামারী মোঃ আরিফুর রহমান ও মোখলেছুর রহমান। তারা দু’জন মিলে বাউসি, আসমা ও সাহতা ইউনিয়নে মোট ৩৪ একর পুকুরে পাবদা, গুলশা, তেলাপিয়া, সিং, রুই, কাতল, কার্ফু ও সিলভার মাছের চাষ করেছিলেন। তারা জানান, কিছু কিছু মাছ তারা বিক্রি শুরু করেছিলেন। ২ কোটি টাকার উপরে মাছ বন্যার কারণে খামার থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ইসলামী ব্যাংক ও আল আরাফা ব্যাংক থেকে মাছ চাষের জন্য তারা ১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই ঋণ তারা কবে কিভাবে শোধ করতে পারবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
বাউসি ইউনিয়নের অন্য এক মৎস্য চাষী মোঃ ইলিয়াছ তালুকদার জানান, আমরা এখন ঋণের আতঙ্কে আছি। সব শেষ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম ঘুরে দাঁড়াবো। সে আশা তো এখন বাদ। কিভাবে কি যে হবে! কৃষি ব্যাংক থেকে ১১ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে ছিলাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অন্য জায়গা থেকেও ঋণ নিয়েছি। মোট ৩০ লক্ষ টাকা ফিসারিতে ইনভেস্ট করেছিলাম। বন্যার কারণে আমাদের চাষের মাছ সব পুকুর থেকে চলে গেছে। পাঁচটি পুকুরে তেলাপিয়া, পাবদা ও গুলশান মাছ চাষ করেছিলাম। ভাবছিলাম বিক্রি করে ঋণ শোধ করে লাভবান হব। এখন দেখছি ঋণ শোধ করতে করতেই জীবন পার করতে হবে। ঋণশোধের আতঙ্কে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। ব্যাংক যদি বর্তমান পরিস্থিতি আমলে নিয়ে আমাদেরকে একটু দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দেয় তাহলে খুব ভালো হবে।
জেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর জানিয়েছেন, বন্যার কারণে জেলার ১৫ হাজার ৮২৬ জন মৎস্য চাষী ও খামার মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মোট ২৬ হাজার ৪১৭টি পুকুর, দীঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আয়তন ৩ হাজার ৫৩৮ দশমিক ৯৪ হেক্টর। ভেসে-যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমান যথাক্রমে ৮ হাজার ২৪৭ দশমিক ৫১ মেট্রিক টন ও ৩ হাজার ৭৪১ দশমিক ৮৯ লক্ষ। ভেসে-যাওয়া মাছ ও পোনার মূল্য যথাক্রমে ৭৬৭ দশমিক ৫৪ লক্ষ টাকা ও ২৩০ দশমিক ৩২ লক্ষ টাকা। অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৯৬.৫৪ লক্ষ টাকা। সবমিলিয়ে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১৫৭ দশমিক ৭৭ লক্ষ টাকা।