ডিবিএন ডেস্কঃ আজ ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী পবিত্র ‘লাইলাতুল কদর’ পালন করবে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। মহিমান্নিত এই কদরের রাতেই নাজিল হয়েছিল মানব জাতির হেদায়েতের গ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্য নেয়ামত এই কদরের রাত। ‘শব’ ফারসি ও ‘লাইলাতুন’ আরবি শব্দ, যার অর্থ রাত্রি। আর কদর অর্থ সম্মান ও মাহাত্ম্য। তাই শবে কদর তথা লাইলাতুল কদর অর্থ হচ্ছে সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা মর্যাদার রাত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (আল-কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনি। এই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতা ও রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয়। শান্তি, যা বিরাজ করে সেই রাতের ফজর পর্যন্ত (সুরা কদর, ১-৫)।’
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব : কদরের ফজিলত বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে আলাদা একটি সূরা অবতীর্ণ করেন। কেবল কোরআন নয় বরং হাদিসেও কদরের ফজিলত রয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে।
কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরায়ে কদরে এরশাদ করেন-নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআনুল কারীমকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। উক্ত রজনীতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল (আ.) তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন এটা শান্তিময় রজনী যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা আল কদর : ১-৫)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয় আমি তা (কোরআন) এক মোবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা আদ দুখান : ১-৪)।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হযরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (তাফসিরে মাজহারি)।
মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি, হাদিস নং : ৬৭২)।
লাইলাতুল কদর কবে?
লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোনও তারিখ নেই। অনেকেই মনে করেন ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদরের রাত। আসলে এ ধারণাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনও বলেন নি যে, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজন পর্যন্ত বেজোড় যে কোন রাতই শবে কদর হতে পারে।
লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতসমুহে তা খোঁজ করবে। (বুখারি, হাদিস নং :৭০৯)।
রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)।
একদা হযরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের বেজোড় শেষের দশ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজনের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে। (মুসলিম, হাদিস নং : ৮২৩)। তাই ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত রাসূল (সা.) বলেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল।
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬৭)।
লাইলাতুল কদরে আমরা কী করব?
হযরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানের শেষ দশকে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়ার মধ্যে এত বেশি সময় দিতেন, যা অন্য সময়ে দিতেন না। আয়েশা (রা.) থেকে ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, রমজানের শেষ দশরাত্রি শুরু হলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত জেগে ইবাদত করতেন তার পরিবারবর্গকে জাগিয়ে তুলতেন এবং স্ত্রী-সহবাস থেকে বিরত থাকতেন।
ইমাম আহমাদ ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, “তিনি রমজানের শেষ দশকে এত বেশি ইবাদত করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াব পাওয়ার আশায় রাত জেগে নামাজ আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে লাইলাতুল কদরে (ভাগ্য রজনীতে) নামায আদায় করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” [সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম] এই হাদীস প্রমাণ করে যে, ভাগ্য রজনীতে কিয়ামুল লাইল (রাত্রীকালীন নামায) আদায় করা শরীয়তের বিধান।
লাইলাতুল কদরে (ভাগ্য রজনীতে) পঠিতব্য সবচেয়ে ভালো দোয়া হচ্ছে- যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রা.) কে শিক্ষা দিয়েছেন। যেটি তিরমিযি আয়েশা (রাঃ) থেকে সংকলন করেছেন এবং সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।
আয়েশা (রাঃ) বলেন- আমি বললাম,“হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি জানতে পারি কোন রাতটি লাইলাতুল কদর (ভাগ্য রজনী) তবে সে রাতে আমি কী পড়ব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বলবে- “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউউন তুহিব্বুল ‘আফওয়া ফা ‘ফুউ ‘আন্নী (অর্থ: হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে আপনি ভালবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।)
তাই পবিত্র লাইলাতুল কদরের ফজিলত অপরিসীম। তাই সারা রাত জাগরণ করে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা কর্তব্য। বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, উমরী কাজা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সাদকা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইসতেগফার, দুয়া-দুরূদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনযোগী হওয়া একান্ত জরুরি।