নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর আত্রাইয়ে ভারতীয় জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্য নির্মান করা হয়েছে। কিন্তু ভাস্কর্য নির্মানের পর সেখানে লোহার রড দিয়ে খাঁচা বানিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। এতে করে দর্শনার্থীরা যেমন ভাস্কর্যটি উপভোগ করতে সমস্যায় পড়ছেন, অন্যদিকে ভাস্কর্যটির সৌন্ধর্য বিনিষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
জানা যায়, ইংরেজ সামাজ্র্যবাদের নির্যাতনের যাঁতাকলে যখন পিষ্ট ভারতবর্ষবাসী। তাদের জুলুম ও নিপীড়নে অতিষ্ট বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ। সে সময় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনমনে জায়গা করে নেন ভারতবর্ষের কিংবদন্তি নেতা মহাত্মা গান্ধি। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ধর্ম-বর্ণের উর্দ্ধে থেকে তিনি এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইংরেজদের পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে জনমত সৃষ্টি করেন। মহাত্মা গান্ধি এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ১৯২৫ সালে নওগাঁর আত্রাইয়ে এসেছিলেন তিনি। সে সময় তিনি আত্রাই রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন তেতুঁলিয়া নামক স্থানের বর্তমান গান্ধী আশ্রমে অবস্থান করে এলাকার অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করেন। সেই সাথে এলাকার মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে তিনি এখানে খদ্দর কাপড় তৈরির তাঁত শিল্প স্থাপন ও খাঁটি সরিষার তেলের জন্য ঘানি স্থাপনসহ অনেক স্মৃতিচিহ্নই গড়ে তোলেন। তৎকালীন সময়ে বানভাসী মানুষদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে তিনি এখানে স্থাপন করেন বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি (বিআরসি)। গান্ধি আশ্রম এর পাশেই তেতুঁলিয়া তিন মাথা মোড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে ২০২০সালের শুরুর দিকে নওগাঁ – ৬ (আত্রাই- রাণীনগর) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম ও ভারতীয় হাই কমিশনার যৌথ অর্থায়নে মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্য নির্মানের উদ্যোগ নেয়।
ভাস্কর্য নির্মানের দায়িত্ব দেয়া হয় রাজশাহীর ভাস্কর শিল্পী মাহাফুজুর রহমান (ডন) কে। ভাস্কর্য নির্মানে মোট খরচ হয় ৩লক্ষ ৩০হাজার টাকা। এর পর ওই বছরের ২৭জুলাই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এমপি ইসরাফিল আলম। তার পর ২০২১সালের ২অক্টোবর ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়।
ভাস্কর্যটির উদ্ধোধক ছিলেন ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার সঞ্জীব কুমার ভাটী। প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন হেলাল। কিন্তু ভাস্কর্যটি নির্মানের পর চারদিক দিয়ে লোহার রডে ঘিরে দেয়া হয়েছে। যার কারনে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বিনিষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। এমন অবস্থায় দ্রুত ভাস্কর্যের চারদিক থেকে লোহার রডের খাঁচা সরিয়ে ফেলে ভাস্কর্যের নিচের অংশে বেদিটি আরো কয়েক ফুট বড় করার জন্য দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা অরুন চন্দ্র সাংবাদিক কে বলেন, প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষ আসে মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্য দেখতে কিন্তু মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্যটির চারপাশে এমন ভাবে লোহার রড দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে, দেখে মনে হয় চিরিয়াখানার মত। কাজটি ঠিক হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত ছিল বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার।
নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুর রশিদ বলেন, ১৯২৫ আত্রাই রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন তেতুঁলিয়া নামক স্থানের বর্তমান গান্ধী আশ্রমে অবস্থান করে এলাকার অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করেন ভারতীয় জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধি। একই সাথে এলাকাবাসীকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে এখানে খদ্দর কাপড় তৈরির তাঁত শিল্প স্থাপন ও খাঁটি সরিষার তেলের জন্য ঘানি স্থাপনসহ অনেক স্মৃতিচিহ্নই গড়ে তোলেন। তৎকালীন সময়ে বানভাসী মানুষদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে তিনি এখানে স্থাপন করেন বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি (বিআরসি)। এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির ভাস্কর্য যেন লোহার খাঁচায় বন্ধি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আলম মহাত্মা গান্ধি ও পিসি রায় মেমোরিয়াল হল গড়ে তুলেছিলেন। তারপরই উদ্যোগ নেয় মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্য নির্মানের কিন্তু তিনি কাজটি দেখে যেতে পারেননি। তার উদ্যোগগুলো মহৎ ছিল। বর্তমানে যারা জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন এর দায়িত্বে আছেন তাদের উচিত ভাস্কর্যটির চারপাশের লোহার রড দিয়ে ঘিরে দেয়া খাঁচা সরিয়ে ফেলে আরও কিভাবে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বিকশিত করা যায় তার উদ্যোগ নেয়ার।
ভাস্কর শিল্পী মাহাফুজুর রহমান ডন এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, এটি সরকারি উদ্যোগে করা হয়নি। সে সময় প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আলম সাহেব ও ভারতীয় হাই কমিশনার এর উদ্যোগে ভাস্কর্য নির্মানের কাজ করা হয়েছিল। আর ভাস্কর্যটি নির্মানের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। মোট খরচ হয়েছিল ৩লক্ষ ৩০হাজার টাকার মত। আর যতদূর জানি পরববর্তীতে চারপাশের বসার বেঞ্জ এর কাজ স্থানীয় উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। তখন আমাকে যেভাবে কাজ করতে বলা হয়েছিল, আমি ঠিক সেই ভাবেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলাম।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাস্কর্য ও চারপাশের ডিজাইন এর সাথে কি এই কাজের মিল আছে, আর ভাস্কর্যটির চারপাশে যে লোহার রড দিয়ে খাঁচা নির্মান করা হয়েছে এতে করে কি ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বিনিষ্ট হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে এই ভাস্কর শিল্পী বলেন, হ্যা আমার কাছে মনে হচ্ছে কাজটি ঠিক নয়, তবে যেহেতু রাস্তার পাশে যার কারনে সিকিউরিটির কথা বিবেচনা করে ভাস্কর্যটির চারপাশে ঘিরে দেয়া হয়েছে। উদ্ধোধনের সময় কিন্তু ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার সঞ্জীব কুমার ভাটীসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সে সময় এ বিষয়ে তারা কোন মন্তব্য করেননি। তবে যদি স্থানীয় প্রশাসন চায় সেটিকে আরও পরিপাটি করে সৌন্দর্য বর্ধন এর উদ্যোগ নিতে পারেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ( ইউএনও ) মো: ইকতেখারুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধির ভাস্কর্য নির্মান উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে করা হয়নি। প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আমল মহোদয় ও ভারতীয় হাই কমিশনার এর পরিকল্পনা ও অর্থায়নে করা হয়েছে। আমরা শুধু কাজটি তদারকি করেছিলাম মাত্র।
চারপাশে লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে দেয়ার কারনে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বিনিষ্ট হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখুন ভাস্কর্যটি উদ্বোধনের সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। তখন তারা এসব নিয়ে কোন কথা বলেনি। যেহেতু আমরা কাজটির পরিকল্পনার সাথে যুক্ত নয়, সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত হবে বলে মনে করিনা। যদি আগামীতে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আরও কোন উদ্যোগ নেয়া হয় সেটি একটি পরিকল্পনার বিষয়। তবে, যতদূর জানি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করেই হয়তো ভাস্কর্যটির চারপাশে ঘিরে দেয়া হয়েছে।