৭১ সালের ১৭ই মার্চ বাঙ্গবন্ধু তৎকালিন প্রেসিডেন্ট হাউস (মিন্টু রোড) থেকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে বেড়িয়েছেন। উৎসুক জনতা সহ বহু সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেছে। ভিড় ঠেলে এক সাংবাদিক সামনে এসে প্রশ্ন করলো ” আজ আপনার জন্মদিন, কিভাবে উদযাপন করবেন এই জন্মদিন?”। বঙ্গবন্ধু বললেন ” আমি জন্মদিন পালন করিনা। আমি আমার জীবন এ দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি”- এটাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং এ জন্যই তিনি জাতির পিতা।
একবার টরন্টোতে ১৭ই মার্চ উপলক্ষে আমরাও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেননা) জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। আমরা সকলেই বঙ্গবন্ধুর জীবন উল্লেখ করে বক্তৃতা করেছি। নেত্রী আমাদের বক্তৃতা শুনে ভাবাবেগে সিক্ত হয়েছিলেন। বক্তৃতা করতে গিয়ে নেত্রী তার নিজের কথা বললেন ” ১৫ই আগষ্ট আমরা দুই বোন ছিলাম বিদেশে। বহু প্রতিকুলতা এড়িয়ে আমরা জার্মানীতে যাই। সেখানে বাংলাদেশের হাই কমিশনারের বাসায় আশ্রয় নেই (জার্মানীতে তখন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন হাই কমিশনার)। ঘরে বন্ধি জীবন আর কান্নাকাটি করে আমরা নির্জীব হয়ে পরেছি। একদিন মিসেস চৌধুরী আমাদেরকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। আমরা একটা মলে ঢুকে হাটাহাটি করছি। একজন জার্মান মহিলা আমার ছেলেকে দেখে কাছে আসে আদর করলেন। আমার সঙ্গে হ্যন্ড শেক করে জানতে চাইলেন কোন দেশ থেকে এসেছি। হয়ত আমার বিষন্ন চেহারা দেখে তারও মায়া হয়েছে! আমি বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি আমার হাতটি ছেড়ে ঘৃনার চোখ নিক্ষিপ্ত করে বলে উঠলেন ” যাও! তোমার সঙ্গে কথাই বলবোনা, তোমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছো”। আমি নির্বাক মহিলাটির দিকে চেয়ে থেকেছি। বলতে পারিনি আমি মুজিবেরই অভাগা মেয়ে।
আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হচ্ছে সারা দেশে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করছে ঘটা করে। অথচ ৭৫ এর পরে বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসটিকেও মিথ্যা জন্মোৎসব বানিয়ে উপহাস করেছে- কেউ প্রতিবাদ করেনি। সেই বাঙালী আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মোৎসব নিয়ে মাতামাতি করছে দেখে খটকা লাগতেই পারে। এ দিনটি কি শুধুই জন্মোৎসব? বঙ্গবন্ধু বাঙালীর লালিত স্বপ্ন স্বাধীন একটি দেশে এনে দিয়েগেছেন। জীবনের ১৩টি বছর নিত্য সম্মুখিন হয়েছেন ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার। সাধারন জীবনযাপন করেছেন অন্য দশজন নাগরিকের মত। শৈশব থেকে যৌবন আর প্রতিদিন বাঙালীর ভাগ্য বদলের স্বপ্ন বুনেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতা যূদ্ধের জন্য। ৭০ এর নির্বাচনে বাংলাদেশ মানুষ পুর্ন সমর্থন দিয়েছে মুজিবকে। চাইলে মুজিব অনায়েশেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে সুখভোগ করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু তা করেননি। নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমনের প্রতিবাদে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন ও বলেছেন, শেষ শত্রুটি বিতারিত করার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়ে ৯ মাস জেলে বসে মৃত্যুকে দেখেছেন প্রতিদিন।
যারা দিবসটিতে গরম বক্তৃতা করে মঞ্চ কাঁপাবেন তারা অনেকেই জানেনা কেমন করে খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হলেন শেখ মুজিব! কি নির্যাতন সয়েছেন বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিনত করতে! তাই মুজিবকে জানার চেষ্টাই হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখানো- কেক কেটে জন্মোৎসব নয়।
জয় বাংলা
জয়তু বঙ্গবন্ধু
আজিজুর রহমান প্রিন্স, বিশিষ্ট সমাজসেবক, কলামিস্ট, টরন্টো, কানাডা।