তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের পাদ্রী-বাংলা রোডে ‘আব্দুল হাফিজ’ নামে‘মাহমুদুর রহমানের’ পিতা পরিচয়ে কোনও ব্যক্তির সন্ধান মেলেনি। মা পরিচয়ে মেলেনি ‘রাবেয়া বেগম’ নামে কোনও নারীর সন্ধান। শ্রীমঙ্গলের পাদ্রী-বাংলা রোডে খোঁজ পাওয়া যায়নি আত্মীয়তার সংযোগও। কিন্তু এই নাম-ঠিকানা দেখিয়েই ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে দুইবার (রিনিউসহ) পাসপোর্ট নিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব আবুল হারিছ চৌধুরী। পাসপোর্ট নিতে ব্যবহার করেছিলেন একটি সাময়িক জাতীয় পরিচয়পত্র। সেই পরিচয়পত্রে দেওয়া ঠিকানাটিও ছিল ভুয়া। সরকারি সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের সূত্রে খোঁজ মিলেছে ২০১৩ সালে করা তার প্রথম পাসপোর্টেরও। কিভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী ওরফে মাহমুদুর রহমান। কোন নম্বর ব্যবহার করে তিনি পেয়েছিলেন পাসপোর্ট? নিয়ম অনুযায়ী, স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানায় খোঁজ নেওয়ার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ও শ্রীমঙ্গলের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সম্মতিপত্রই বা কোন প্রক্রিয়ায় এসেছিল?
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, তার বাবা মাহমুদুর রহমান পরিচয়ে ঢাকাতেই ছিলেন ১৪ বছর। আর ছদ্মপরিচয়েই গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি। দাফন করা হয়েছে সাভারের জালালাবাদ এলাকার একটি মাদ্রাসার গোরস্থানে। প্রমাণ হিসেবে সামিরা দেখিয়েছেন একটি পাসপোর্ট ও সাময়িক জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি। ছদ্মনামে পাসপোর্ট ও সাময়িক জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছিলেন হারিছ চৌধুরী। পাসপোর্ট তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল পৌরসভার পাদ্রী-বাংলা রোডের ঠিকানা। ঠিকানায় ছিল না কোনও বাড়ি বা বাসার নম্বর। তবে স্পাউস নেম হিসেবে নিজের স্ত্রীর প্রকৃত নাম জোসনা বেগমই উল্লেখ করেছিলেন হারিছ। একইসঙ্গে ইমার্জেন্সি কনটাক্ট হিসেবে ‘ছেলে’ পরিচয়ে ইকবাল হোসেন, ঠিকানা পাদ্রী-বাংলা রোড, শ্রীমঙ্গল ও একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছিলেন তিনি। খোঁজে বেরিয়ে এসেছে এই ইকবাল আহমেদকে ‘ছেলে’ হিসেবে পরিচয় দিলেও তিনি ছিলেন হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি জকিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে করা প্রথম পাসপোর্টের (BA0115662) মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়সীমা ছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে তিনি রিনিউ করতে আবেদন করেন ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। এই পাসপোর্টের নম্বর (BW0952982)। উভয় পাসপোর্টে ইমার্জেন্সি কনটাক্ট পারসন হিসেবে ইকবাল আহমেদ নামে ব্যক্তি ও তার ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। পাসপোর্টে আবেদনকারী হিসেবে যে ফোন নম্বর দিতে হয়, সেখানে এই নম্বরই ব্যবহার করেন হারিছ চৌধুরী।
তার ভাই কামাল চৌধুরী সোমবার (৭ মার্চ) জানান, ইকবাল আহমেদ হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আর হারিছের স্ত্রীর নাম জোসনা বেগম। মা হলেন মৃত সুরুতুন্নেসা ও বাবা মৃত শফিকুল হক চৌধুরী। জকিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইকবাল আহমেদের সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয়। তিনি বলেন, উনি যখন ছিল, এলাকার হিসেবে সম্পর্ক ছিল। উনার সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাই। আমি জানছি, তিনি মারা গেছেন ঢাকাতেই, শুনেছি।
হারিছ চৌধুরীকে কখনও পাসপোর্ট করে দেননি দাবি করে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘তাই নাকি। উনি লিখছে ছেলে হিসেবে? আচ্ছা, দিতে পারেন উনি। উনি তো খুব স্নেহ করতেন আমাকে। মাহমুদুর রহমান নামের প্রথম পাসপোর্ট এন-রোলমেন্ট হয় ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বরে। আবেদনে উল্লিখিত স্থায়ী ঠিকানা অনুযায়ী মৌলভীবাজার জেলা ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চকে তদন্ত করতে ফরোয়ার্ড করা হয়। স্থায়ী ঠিকানার তদন্ত দায়িত্ব শ্রীমঙ্গল থানার। থানায় ওই সময় এসবির ফিল্ড তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন লিয়াকত আলী মোল্লা।
বাংলা ট্রিবিউনকে লিয়াকত আলী মোল্লা জানান, ৮ বছর আগের ঘটনা তিনি নিশ্চিতভাবে স্মরণ করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘ভেরিফিকেশন কীভাবে হয়েছে, তা বলা মুশকিল। ২০১৪ সালে আমার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল। এজন্য এখন কিছুই মনে করতে পারি না। মনে নেই কীভাবে হয়েছিল।
পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীর নম্বর ও ইমার্জেন্সি কনটাক্ট হিসেবে ইকবাল আহমেদের নম্বর উল্লেখ করা হলেও এসবি থেকে কোনও ফোন যায়নি? এমন প্রশ্নে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘মনে হয় না, মনে পড়তেছে না। শ্রীমঙ্গলের পাদ্রী-বাংলা রোডে কোনও কিছু চিনি না। হারিছ সাবের বোনের কাছ থেকে তার মেয়ের খোঁজ-খবর নিয়েছি, উনার মৃত্যুর খবর শোনার পর।
এ বিষয়টি নিয়ে এসবি ঢাকা ব্রাঞ্চের কোনও দায়িত্বশীল মন্তব্য করতে চাননি। সূত্রের দাবি, অভ্যন্তরীণভাবে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত খোঁজ পেতে সময় লাগছে। হারিছ চৌধুরী ছদ্মবেশে মাহমুদুর রহমান নামে যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছিলেন সেটির নম্বর ১৯৫৫২৬৯৪৮১৩০০০০৪৫। তিনি নিজেই নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ছবি তুলে আইডি তৈরি করেন। সেই পরিচয়ে অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয় ‘৫৬/এ মনিপুর-মিরপুর’। স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয় শ্রীমঙ্গলের পাদ্রী-বাংলা রোডের নাম। ২০১৩ সালের আগে করা সাময়িক পরিচয়পত্রে তিনি ‘৫৬/এ মনিপুর-মিরপুর’ অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও বাস্তবে এমন কোনও ঠিকানা নেই।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) দুপুরে মনিপুর এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫৬/এ নামে কোনও ঠিকানা নেই। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, সরেজমিন পাওয়া গেছে দক্ষিণ মনিপুর সড়কের একটি এলাকা। পাশে দেখা গেছে খালি একটি প্লট।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল মনে করেন, ২০১৩ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা খুব কঠিন ছিল না। যেকোনোভাবে জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করে দিলে তা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিজিটাল বাংলা নিউজ কে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর বলেন, এটা আপনার কাছ থেকে শুনলাম। বিষয়টি আমার জানা নেই। যাচাই-বাছাই করে দেখি। যদি বলার মতো কিছু হয়, তাহলে আমরা বলবো।