তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: দেশ কাঁপানো, সাড়া জাগানো গত ১০ জানুয়ারী নুরজাহান আত্মহননের ২৯তম বার্ষিকী নিরবে নিভৃত্বে চলে গেল। মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড় টিলা বেষ্টিত ছোট একটি গ্রাম ছাতকছড়া। সেই গ্রামের আশ্রব উল্লার যুবতী কন্যা নুরজাহান লক্ষী ছিলো ভাই বোনদের মধ্যে চতুর্থ। নুরজাহান বেগম লক্ষীকে প্রথমে বিয়ে হয় শেরপুর এলাকার আব্দুল মতিনের সঙ্গে। বিয়ের পর দীর্ঘ দিন স্বামীর কোন খোঁজ খবর না থাকায় পিতা আশ্রব উল্লা মেয়ে নুরজাহানকে নিয়ে আসেন ছাতকছড়া গ্রামের নিজ বাড়ীতে। পিতার বাড়ীতে নুরজাহান আসার পর স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা আঃ মান্নান গৃহবধু সুন্দরী নুরজাহানের প্রতি কু-নজর পড়ে এবং তাকে বিয়ে করার জন্য নুরজাহানের পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।
নুরজাহানের পিতা আশ্রব উল্যা মাওলানার প্রস্তাবে রাজী না হয়ে একই গ্রামের মোতালিব মিয়ার সঙ্গে নুরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেন। এই দ্বিতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে সুত্রপাত ঘটে এই হৃদয় বিদারক নুরজাহানের আত্মহননের মত ঘটনায় সৃষ্টি।
বিয়ে করতে না পেরে মাওলানা আঃ মান্নান প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং নানা ছলচাতুরী শুরু করে। বিয়ের ৪৫দিন পর মাওলানা আঃ মান্নান নুরজাহান ও আব্দুল মতলিবের ২য় বিয়েকে অবৈধ বলে ফতোয়া জারী করে এবং গ্রাম্য সালিশের ডাক দেয়।
মাওলানা মান্নানের কথা মত ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারী সকালে একই গ্রামের নিয়ামত উল্লার বাড়ীতে গ্রাম্য সালিশী বিচার বসে। সালিশী বিচারে গ্রামের মনি সর্দার, দ্বীন মোহাম্মদ, নিয়ামত উল্লা ও মাওলানা আঃ মান্নান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নুরজাহান ও মতলিবের পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করে। সেই বিচারে গৃহবধু নুরজাহানকে মাটিতে পুঁতে ১০১ টা পাথর নিক্ষেপ করার রায় ঘোষনা দেয়া হয়। সালিশী রায় কার্যকর করার পর উপস্থিত গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া নুরজাহানের উদেশ্যে বলতে থাকে এত কিছুর পর তোর বেঁচে থাকা উচিত নয়। তুই বিষ পানে মরে যাওয়া উচিত।
গ্রাম্য এ সর্দারের কটাক্ষ উক্তি সহ্য করতে না পেরে ক্ষোভে ও দুঃখে গৃহবধু নুরজাহান লক্ষী সেই দিনই বিষ পানে আত্মহনন করে। ২০০৯ সালের জুন মাসে নুরজাহানের মা ছাতকছড়া গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউপির গোপীনগর গ্রামে বাড়ি কিনে ২ ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন। ১০ জানুয়ারী নুরজাহান আত্মহননের ২৯তম বার্ষিকী।
যে রায়ে অত্মহনন করে গৃহবধু নুরজাহান : অপমানের জন্য আত্মহত্যা করেছে গৃহবধু নুরজাহান সেটি ছিল আংশিক। পূর্ণাঙ্গ ফতোয়ায় ছিল নুরজাহান ও তার স্বামী মতলিবকে গলা পর্যন্ত গর্তে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককে ১০১টি পাথর নিক্ষেপ করা এবং ১০১টি বেত্রাঘাত করা হবে। নুরজাহানের বাবা আশ্রব উল্যা ও মা সায়েরা বেগমসহ বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে কানে ধরে উঠ বস করতে হবে। বিচারে উপস্থিত মতলিবের বাবা, নুরজাহানের শশুর মতিউল্লা ফতোয়ার এ শাস্তি কমানোর আবেদন করিলে ও বিচারে উপস্থিত গ্রামবাসীর অনুরোধে গর্তের গভীরতা গলা থেকে কোমর পর্যন্ত কমে আসে এবং ১০১ ঘা বেত্রাঘাত কমে ৫১ ঘা করা হয়। শেষ পর্যন্ত দু’ পিঠে ১০২ ঘা বেত বসানো হয়।
যে ভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো : সংবাদপত্রের কল্যাণে ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার লাভ করলে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ এ ঘটনার প্রতিবাদে রুখে দাড়ান। দেশের নারী আন্দোলনের প্রথম সারীর নেত্রী বেবী মওদুদ, অ্যাড. আয়েশা খানম, মালেকা বেগমসহ জাতীয় দৈনিকগুলোর নামী দামী সাংবাদিক, কলামিষ্ট, লেখকদের অনেকেই ছুটে আসেন এ অখ্যাত গ্রামে।
প্রথমদিকে পুলিশ প্রশাসন বিষয়টির ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে অভিযুক্ত ইমাম আব্দুল মান্নান, দ্বীন মোহাম্মদ, আব্দুল মিয়া, নিয়ামত উল্লা, এছামত উল্লা, সুনা মিয়া ও বুরহান উদ্দিন নামে ৯ জনকে গ্রেফতার করলেও আদালতে ফাইনাল চার্জ সীট জমা দিতে সময় লাগে ৪ মাস। অতঃপর ১৯৯৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারী অভিযুক্ত ৯ জন আসামী প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে আদালত। সাজাপ্রাপ্ত ৯ জনের মধ্যে ৮ জন সাজা ভোগ করার পর এলাকায় ফিরে এসেছে। মামলার ১নং আসামী মনির সর্দার জেলহাজতে থাকাবস্থায়ই মারা যান।
যে আশার বাণী শোনানো হয়েছিল গ্রামবাসীকে : হতভাগী নুরজাহানের আত্মহননের ঘটনার পর সরকারী উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় সেই সময়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দূর্গম গ্রামটির রাস্তা সংস্কার এবং কালভার্ট তৈরী করা হবে এবং রাস্তাটির নামকরন হবে নুরজাহানের নামেই। যে টিলায় নুরজাহানকে কবর দেয়া হয়েছিল তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেই টিলাটির নামকরন করেছিলেন “নুরজাহান টিলা”।
এছাড়া নারী পরিষদ নুরজাহানের কবর পাকা করনেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই টিলাটি অন্য ব্যক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় সেখানে লাগানো হয়েছে নানান জাতের গাছ গাছালি। এমনকি আরও অনেক আশার বাণী শোনানো হয়েছিল গ্রামবাসীকে। কিন্তু সেই আশার বাণীই আশাতেই রয়ে গেছে। দীর্ঘ ২৯ বছর পূর্বে যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে গ্রামটি। গ্রামের কোন পরিবর্তন হয়নি।
ফতোয়াবাজীর ঘটনার শিকার নুরজাহানের আত্মহননের ঘটনার পর যে টিলায় তাকে কবর দেয়া হয়েছিল সেটি এখন গভীর অরণ্যে ঢাকা। নুরজাহান টিলা হিসাবে পরিচিত এই কবর স্থানটি সংস্কার বিহীন অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে বর্তমানে সেই কবর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
নিরবে নিভৃতে চলে যাওয়া ফতোয়াবাজদের শিকার নুরজাহান লক্ষী আত্মহননের ২৯ তম বার্ষিকী ১০ জানুয়ারি। প্রথম দিকে স্মরণ করা হলেও এখন কেউ স্মরণ রাখে না।