সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী অনুপম সেন সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের পূজা মণ্ডপ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রতিবাদে ১৮ই অক্টোবর সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ের অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি এ আহ্বান জানান।
‘সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক-মানবতা মুক্তি পাক’ এই স্লোগান নিয়েই সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামে বিক্ষোভের আয়োজন করেন।
বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী অনুপম সেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আমি দাবি করছি যে, এরশাদ ১৯৮৮ সালে যে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিল তা এখন বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানকে একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে
“যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকে, তবে অন্যরা হবে এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আর যদি বলেন সবাই এই স্বাধীন দেশের নাগরিক, তবে তো কোনভাবে এখানে রাষ্ট্রধর্ম থাকতে পারে না।”
১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি ধরে যে বাংলাদেশ এর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তার যাত্রা হয় সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সময়ের সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধানে ৮ম সংশোধনী দ্বারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন সংবিধানে।
এরপর যদিও সংবিধান অনেকবার সংশোধিত হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের বিধানটি অপরিবর্তিত হয়েই রয়ে গেছে।
অনুপম সেন আরও বলেন, “বাংলাদেশের এক সম্প্রদায়ের নাগরিকদের দুর্গাপূজাকে নানাভাবে ধ্বংস করেছে অন্য সম্প্রদায়ের লোকরা। আমি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। এক্ষেত্রে, প্রশ্ন করতে পারেন, কী করেছেন আপনারা?
“আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে মাত্র ১০ মাসে এক অসাধারণ সংবিধান দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ কোন হিন্দু বা মুসলমানের নয় এবং সেই সাথে তিনি সেদিন খুব সুন্দর করে যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন আরও বলেছিলেন যে, দেশে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্মকে অপব্যবহার করতে পারবে না।”
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের তৎপরতায় হতাশা প্রকাশ করেন, অনুপম সেন।
তিনি আরও বলেন, “ছাত্রলীগকে এখন মাঠে নেমে কাজ করতে দেখা যায় না। শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ। এত বড় সংগঠন আওয়ামী লীগের, সাথে রয়েছে আরও নানা অঙ্গ সংগঠন। কিন্তু তারা কেউ কেন রাস্তায় নেই
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনি বলছেন, শাস্তি হবে দোষীদের। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এ নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু এতদিন অবধি কেন তদন্ত চলবে? অবিলম্বে তদন্তের খবর দিন জনগণকে। শাস্তির ব্যবস্থা নিন হামলাকারীদের। প্রতিদিন একের পর এক হামলা হচ্ছে। গতকালও রংপুরে অতর্কিত ভাবে হামলা চালানো হয়েছে। প্রশাসন কী করছে এখানে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের সামনে উপস্থাপন করুন কাদের ধরা হয়েছে। আইনের আওতায় নিয়ে আসুন হামলাকারী ও সকল অপরাধীদের।”
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকেও অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “মিডিয়া এতদিন অল্প অল্প করে দিয়েছিলেন। সেটা পাকিস্তান আমলে হয়েছে। কিন্তু এখন বলুন। সব কাগজে হেডলাইন দিন- ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’। প্রতি টেলিভিশনে প্রচার করুন- ‘বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াও’।”
সমাবেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তও উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি বলেন, “আজকের এই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর গড়া বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে, কিন্তু এই দল বঙ্গবন্ধুর দল নয়।
“সংবিধানে এখন বাংলাদেশ আছে, পাকিস্তানও আছে। বঙ্গবন্ধু আছেন সাথে আবার জিন্নাহ সাহেবও আছে। দলে অনেক মোশতাক। মুজিব কোট গায়ে দিয়ে পাকিস্তানি প্রেতাত্মার সাথে মেলবন্ধন করে এ হামলাগুলো প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক দৃষ্টি হতভাগ্য জনগণের কাছেও পৌঁছায় না।”
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে দেশের সব মানুষকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত ।
তিনি এই বিষয়ে আরও বলেন, “পুলিশ বিডিআরের উপর নির্ভর করে হামলা থেকে রক্ষা মিলবে না কখনো। সকল রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক জনগণ, ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামা, পুরোহিত-যাজককে সংঘবদ্ধভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।”
তা না হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত।
সমাবেশে উপস্থিত কবি আবুল মোমেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে শুরুতেই বলেন, “লজ্জায় অধোবদন। যখনই সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে, তখনি বুঝে নিতে হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। আজ কোনো রাজনৈতিক দল মাঠে নামেনি।”
“দেশ বিভাগের সেই ১৯৪৭ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দুদের উপর বারবার হামলার প্রধান কারণ ছিলো সম্পত্তি দখল। কিন্তু আবার ঘটনার সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে সব রাজনৈদিক দল মিলেমিশে যায়।”
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাসহ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার উপর জোর দেন তিনি।
এসময় সমাবেশে উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, “সরকারের কাছে আশা করে কোন লাভ নেই। এলাকায় এলাকায় সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রতি পাড়া মহল্লায় কমিটি গড়তে হবে।”
এছাড়াও সমাবেশে উপস্থিত খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, “যারা আজ হামলার সমর্থন দিচ্ছেন এবং নীরবতা পালন করছেন, তারাও কেউ রক্ষা পাবেন না। তারা অন্ধকারের মানুষ। এরা কাউকে ছাড়বে না এবং কখনো ছাড়ে না।
“কিন্তু যাদের আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছি, তারা কী করছেন? রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা কী করে অবহেলা করছে? কারও জন্য বসে থাকব না আমরা। আমরা মাঠে নামব, আন্দোলন করব।”
আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে এইদিন বক্তব্য রাখেন আরও অনেক বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে ছিলেন- নারী নেত্রী নূরজাহান খান, সিপিবি জেলা সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো ইউনুচ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা কল্পনা লালা, নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, ওমর কায়সার ও হাসান ফেরদৌস, মহিলা পরিষদ চট্টগ্রামের সভানেত্রী লতিফা কবীর, জাসদ নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, সঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়সী রায়, চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী, নাট্যজন শুভ্রা বিশ্বাস।