বাংলাদেশে আজ ১৫ই অক্টোবর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর রাজধানী ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় এবং চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার শাহী জামে মসজিদ এর রহমতগঞ্জ এলাকায় জে. এম সেন হল প্রাঙ্গণে ও নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীতে পুলিশের সাথে লোকজনের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
ঢাকার মিছিলে ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজের’ একটি ব্যানার দেখা গেছে আর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার শাহী জামে মসজিদ এর নামায শেষে অসংখ্য মুসল্লিদের অংশগ্রহণে এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। অন্যদিকে চৌমুহনীতে মিছিলকারীদের ব্যানার এ ছিলো ‘তৌহিদী জনতা।’
কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদে ঢাকায়, চট্টগ্রামে ও নোয়াখালীর চৌমুহনীর মিছিলকারীরা রাস্তায় নামলে পুলিশের বাঁধার মুখে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
গত বুধবার অষ্টমী পুজার দিন কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর ওই ঘটনার জের ধরে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এ নিয়ে সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছে সাথে ঘটেছে ধর্ষণের মত বর্বরোচিত ঘটনা যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পূজামণ্ডপে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এছাড়াও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে সংঘর্ষের জের ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা চালানোর খবর পাওয়া গেছে। আর এ সময় যতন কুমার সাহা নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিশ্চিত করেছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বুধবারই ২২টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন।
এদিকে শুক্রবার ভোর থেকে দেশজুড়ে মোবাইল ফোনে ফোরজি থ্রিজি ইন্টারনেট বন্ধ ছিল পরবর্তীতে বেলা চারটার দিকে তা আবার চালু হয়েছে।
ঢাকায় কেন সংঘর্ষ হলো
প্রত্যক্ষদর্শীরা এই বিষয়ে বলছেন যে, বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজের মোনাজাত শেষ হওয়ার আগে এক দল ব্যক্তি শ্লোগান দিতে শুরু করে।
তারা মিছিলসহ বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের মসজিদের গেইটে বাঁধা দিয়েও আটকে রাখতে পারেনি। মিছিলকারীরা সেখান থেকে বের হয়ে পল্টন মোড়ে আসলে সেখানে এবং আরো পরে বিজয়নগরেও বাধা দিয়ে পুলিশ তাদের আটকে রাখতে পারেনি।
পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে তারা অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে কাকরাইল মোড়ে তিন দিক থেকে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের ঘিরে ফেলে পুলিশ এবং সেখান থেকেই শুরু হয় সংঘর্ষ।
সংঘর্ষ চলাকালে দুপক্ষের সাথেই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় এবং মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ও শটগান থেকে গুলি ছুঁড়ে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান যে, টানা ১০/১৫ মিনিট দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পরে আরও অন্তত আধা ঘণ্টা থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছিল ঐ এলাকায়।
সোয়া দু’টার পর র্যাব সদস্যরা সহ এসে পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পুলিশের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, এই হামলায় অন্তত পাঁচ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে।
নোয়াখালীর চৌমুহনীতে পূজামণ্ডপে অতর্কিত হামলা
কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জের ধরে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেশ কয়েকটি মন্দিরে কিছু উগ্র মুসল্লি অতর্কিতভাবে হামলা করে। হামলা করার ঐ সময়ে পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এছাড়াও এরা নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পূজামণ্ডপ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালিয়েছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আর হামলার সময় গতকাল শুক্রবারের এ ঘটনায় তখন যতন সাহা (৪২) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এবং সেখানে যতন কুমার সাহা নামে এ একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন জেলার সহকারী পুলিশ সুপার শাহ ইমরান। আর আহত হয়েছেন অন্তত ১৮ জন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে বেগমগঞ্জের ছয়ানি বাজার এলাকার একটি মণ্ডপে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া এখলাসপুরের একটি মন্দিরের ভেতরে ঢুকে মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুন নাহার।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর
শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর চট্টগ্রাম নগরীতে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে মুসল্লিদের অংশগ্রহণে কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশ করে। সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে জে. এম সেন হলের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় এবং নরকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জে. এম সেন হলের পুজোতে।
মোড়ে ট্রাফিক বিভাগের বেষ্টনী দেয়া থাকা স্বত্তেও তারা তা ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকে। জেএমসেন হল প্রাঙ্গণের প্রধান ফটক আগে থেকে বন্ধ থাকায় উচ্ছৃঙ্খল এই মুস্ললিগণ গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে এবং ভেতরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলে ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় তারা পূজার উপলক্ষে সড়কে তৈরি করা মণ্ডপের গেট ভেঙে ফেলে এবং আশপাশের দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এদের মূল উদ্দেশ্যেই ছিল প্রতিমা ভাংচুর করা এবং মন্ডপে উপস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করা।
জেএমসেন হলে হামলার শঙ্কায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এবং পূজা কমিটির নেতাকর্মীরা আগে থেকেই সড়কে অবস্থান নেন। আর দুপুরে হামলার পর পরিষদের নেতারা ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত’ প্রতিমা বিসর্জন না দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিন।
আর দুপুর ৩টার দিকে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত জেএমসেন হলের মোড়ে এসে পূজা উদযাপন পরিষদের দাবির সঙ্গে তিনি নিজেও একাত্মতা প্রকাশ করেন। সেই সাথে জেএমসেন হল মোড়ে টানা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আজ শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেন। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি এ কর্মসূচি প্রতিহত করতে চাই তাহলে বুকের রক্তের বিনিময়ে হলেও তা প্রতিরোধ করা হবে।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণত প্রতি বছর ১১টা থেকে বিসর্জনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু এবার সরকারি নির্দেশনা ছিল নামাজের জন্য দুপুর আড়াইটার পর থেকে যেন পূজামণ্ডপ থেকে বিসর্জনের জন্য বের হয়। সেজন্য আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মণ্ডপে অপেক্ষা করে আমাদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছিলাম। আর ঠিক এ সময় আমাদের এখানে হামলা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিমা বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর মহানগর মণ্ডপের প্রতিমা সদরঘাটের নেভাল টু’তে বিসর্জন দেয়া হবে এবং অন্যান্য পূজামণ্ডপের প্রতিমা নিজ নিজ সুবিধাজনক স্থানে বিসর্জন দেয়া হবে।