মনে খুব কৌতুহল ছিল মীরজাফরের বংশধরদের একবার নিজ চোখে দেখব। সেজন্য গেল বছর (২০২০ সালে) জানুয়ারি মাসে ভারতের বহরমপুর হয়ে মুর্শিদাবাদ ও বগবানগোলা সপ্তাখানেকের একটা ট্যুর দিয়েছিলাম। সুবে বাংলার অধিপতি নবাব আলিবর্দি খানের নাতি বাংলার শেষ স্বাধীন নাবাব সিরাজ উদ্দোলার হাজার দুয়ারী প্রসাদ ও তার সমাধি, নবাব আলিবর্দি খানের সমাধি দেখে বই পড়া ইতিহাসের সাথে বাস্তবতার মিল খোঁজার চেস্টা করেছি। অনেক খোঁজাখোঁজি ও চেস্টা করে মীরজাফরের বংশধরদের একজনের সন্ধান পেলেও সে নিজের নাম ও পরিচয় আমার কাছে প্রকাশ করে নি, মিথ্যে তথ্য দিয়েছে। তার এহেন আচরন দেখে উপলব্দি করেছি বেইমানদের শেষ পরিনতি এরকমই হয়। মীরজাফর তাঁর জীবদ্দশায় নবাবের সাথে বেইমানির ফল ভোগ করেছে। আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা এখনো মীরজাফরের অপকর্মের সাজা পেয়ে যাচ্ছে, অভিশপ্ত জীবন যাপন করছে, প্রজন্মকে পরিচয় দিতে ভয় ও লজ্জা দুটোই পাচ্ছে। বস্তুত মীরজাফর নামটাও একটা গালিতে পরিনত হয়েছে।
১৭৫৭ থেকে ১৯৭৫, খন্দকার মোশতাক মীরজাফর হয়ে বাংলার ইতিহাসে আরেকটি কালিমা লেপন করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তৎকালিন বি এন পি জামাত জোট সরকার আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায় এবং সেসময় খুঁজে খুঁজে আওয়ামীলীগের যে সব জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করা হয়, শাহ এম এস কিবরিয়া তাদের অন্যতম। আওয়ামীলীগ সরকারের প্রাক্তন এই অর্থমন্ত্রী ছিলেন একজন অতন্ত মেধাবী ও দক্ষ অর্থনীতিবিদ এবং মিষ্টভাষী অতিশয় ভদ্রলোক। তাঁর মত এরকম একজন সজ্জন ব্যাক্তিকে হত্যার কথা শুনে সাইপ্রাস প্রবাসী বাঙ্গালীরা ক্ষোভে ফেটে পরে এবং তৎক্ষনাত প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হল প্রধান অতিথি করা হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা, ভাষা সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রকাশিত ও তৎকালীন প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র ‘জয় বাংলা’ প্রত্রিকার সম্পাদক, লেখক, কলামিস্ট, লন্ডন শেখ মুজিব রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও জীবিত কিংবদন্তী আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে। প্রধান অতিথিকে দাওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া হল আমাকে। ফোনে পরিচয় দিয়ে সাইপ্রাস বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে কিবরিয়া হত্যার প্রতিবাদ সভার কথা জানালাম। শুনেই একবাক্যে আমন্ত্রন গ্রহন করলেন। এ প্রতিবাদ সভাটি ছিল সাইপ্রাসের বাঙালি ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ জনসভা। যেখানে প্রবাসে ৮/১০ জন লোক এক জায়গায় জড়ো করা অত্যন্ত দুরহ কাজ, সেখানে ৩৫০০ লোকের বৃহৎ সভা ছিল সেদিন। সাইপ্রাস ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এদিনটি আমার জীবনে একটি স্মরনীয় দিন। সেদিন একজন জীবিত কিংবদন্তীর উপস্তিতিতে এ সভার সভাপতিত্ব করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সভা শেষে পরেরদিন সব নেতা কর্মীরা চৌধুরি সাহেবের কাছে বঙ্গবন্ধু, ১৫ ই আগস্ট, খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে স্মৃতিচারনের অনুরুধ করলে তিনি অনেক বাস্তব ঘটনার স্মৃতিচারন করেন আমাদের সাথে। তাঁর মধ্যে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম প্রাসঙ্গিক বলে।
আমাদের প্রতিবাদ সভায় আসার বছর দুয়েক আগে রবীন্দ্র জয়ন্তিতে তিনি লন্ডনের একটা হলে রবীন্দ্র সংগীতের একক সংগীতানুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হন। সাথে ছিলেন শেখ মুজিব রিসার্চ সেন্টার লন্ডন এর কর্মকর্তা পারভিন সুলতানা এবং বঙ্গবন্ধুর সাবেক প্রেস সেক্রেটারি প্রয়াত আমিনুল হক বাদশা। শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনে সেদিন চৌধুরি সাহেব অনেক মুগ্ধ হন। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি চা পানের বিরতিতে শিল্পী মঞ্চ থেকে নেমে এলে চৌধুরি সাহেবের মুখমুখি হতেই চাচা সম্বোধন করে সালাম দেন আর চৌধুরি সাহেবও তাঁর পরিচয় জানতে চান। কিন্ত শিল্পী তাঁর নাম পরিচয় না দিয়ে মাথা নিচু করে চৌধুরী সাহেবকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। চৌধুরী সাহেব মনে মনে কস্ট পান। এটি বুঝতে পেরে আমিনুল হক বাদশা বললেন “ গাফফার ভাই আপনি শিল্পীকে চিনেন, তাঁকে ছোট বেলায় তাঁর বাবার সাথে অনেক দেখেছেন । এমনকি ধানমণ্ডি ৩২নং এ অনেকবার দেখেছেন তাঁকে”। এটি শুনার পর চৌধুরী সাহেব আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর পরিচয় জানতে চান আমিনুল হক বাদশার কাছে। আমিনুল হক বাদশা উত্তর দেন “উনি (শিল্পী) হচ্ছেন খন্দকার মোশতাকের মেয়ে। সেজন্যে আপনাকে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেছে।“ ইতিহাসের কি দারুন মিল ! মীরজাফরের বংশধরদের মত খন্দকার মোশতাকের বংশধররাও পরিচয় দিতে ভয় ও লজ্জা পাচ্ছে। যুগে যুগে এভাবেই বেঈমানদের আভির্ভাব হয় কখনো মীরজাফর হয়ে আবার কখনো খন্দকার মোশতাক হয়ে। পরিনামে এসব বেইমানরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় আর তাদের বংশধররা যুগেযুগে তার গ্লানি বয়ে বেড়ায়।
ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাবিবুর রহমান,
প্রধান সম্পাদক,
ডিজিটাল বাংলা নিউজ।