ছোট গল্প – কলমে- শ্যামা:
শোঁ শোঁ আওয়াজে বাতাস বইছে, এ বাতাসে শরীর জুড়ায় কিন্তু মন জুড়াচ্ছে না, মন জুড়াতে আমার দুঃখী মায়ের আঁচল চাই,
অপেক্ষায় আছি সেই সময়টা আসতে আর কতক্ষণ লাগবে, চলেছি লোকাল বাসে অনেক কষ্টে বাসে উঠতে পারলাম, তারপর অনেক ক্ষন বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মাঝপথে একজন যাত্রী নেমে গেল আর সুযোগ বুঝে পছন্দের জানালার পাশে বসে পড়লাম, তবে বাস তো নয় যেন মুড়ির টিন, চলছে হেলেদুলে, কখন কোথায় থেকে, থেমে থেমে কত যাত্রী উঠামানা করছে তার কোন ঠিক নাই।
বাসের জানালার পাশে বসে প্রকৃতি দেখতে বেশ ভালো লাগছে, হঠাৎ দেখি একটা বকুল ফুলের গাছের নিচে একটা কিশোরী মেয়ে ঝড়ে পড়া বকুল ফুল কুড়াচ্ছে, হঠাৎ বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো, কিশোরী যে দেখতে ঠিক মায়ার মত,
মায়া, আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে, কিন্তু সারাক্ষণ আমাদের বাড়িতে ঘুরঘুর করে, আমার মায়ের আঁচল ধরে থাকে,
আমার তো খুব হিংসা হয়, আমার মা ওকে বেশি আদর করে, মাথায় তেল দিয়ে দেয়, সবসময়ই সঙ্গে সঙ্গে রাখে, ভালো কিছু রান্না হলেই আগে মায়া কে খাওয়াতে হবে না হলে যেন মায়ের রান্নাতে কোন আনন্দই নাই। আর মায়ের এমন আদর পেয়ে তো, মায়ার আল্লাদের শেষ নাই।
একবার তো তার পছন্দের বকুল ফুলের মালা গলায় পড়িনি বলে মাকে বিচার দিয়ে বসলো, আর মা তো ইচ্ছে মত আমাকে বকা দিতে লাগলো, এর প্রতিশোধ নিতে আমি তো এক দুপুরে পুকুর ঘাটে মায়া কে একা পেয়ে চুলের মুটি ধরে বললাম, এবার কোথায় যাবি, গতকাল তো মাকে দিয়ে আমাকে অনেক বকা খাওয়ালি, এখন তোর কি হবে মায়া, মেয়েটি আমাকে অবাক করে দিয়ে চুপ হয়ে আছে, আর মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি বললাম কিরে, তোর ব্যথা লাগে না, উল্টো মিটমিটিয়ে হাসছিস, ঘটনা কি উম, ঘটনা কি বল, হাসতে হাসতে বলছে, জীবনে তো এমন করে অনেক মার খেতে হবে, এখন থেকে না হয় সয়ে নিচ্ছি। আমি বললাম মানে কি, মানে কি, কি বলতে চাস হুম, বল।
মায়া বলে উঠলো কি আর, তুমি যে গোঁয়ারের গোঁয়ার, সারাজীবন তো এভাবেই আমাকে মারবে, আমি বললাম, হহ তোকে সারাজীবন মারবো নাহ, ক’দিন পর তো বিয়ে করে শশুর বাড়ি যাবি, তখন, মায়া বলছে তখন থেকেই তো আমার কপালে মার শুরু হবে, কি সব বলছি পাগল টাগল হলি নাকি। তবে যাই বলিস তোর জামাই তোকে কোনদিন মারবে না রে, বলেই চুলের মুটি ছেড়ে দিলাম।
মায়া বললো কে বললো তোমাকে, আমার জামাই আমাকে মারবে না, আচ্ছা তাহলে আমাকে, আমার জামাই কি করবে বল তো।
বললাম হাঁ রে সত্যি বলছি, “তোর মায়াভরা মুখখানি দেখে তোর জামাই মারধর করার কথা ভুলে যাবে, শুধু তোর মায়াবী সম্মোহনী শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে”।
মায়া বলছে সত্যি বলছো, মারবেনা শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, আমি বললাম, আরে গাধী তোর জামাই তোর মায়াবী কপালের দিকে তাকিয়ে থাকবে, মায়া বলে উঠলো, আমি তো তাই বলছি ঘরে ফিরে শুধু গাধার মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে বলো, থাকবে বলো, বল, বল বলোনা! ময়না।
হঠাৎ মায়া আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো আমি যে এই কথাগুলো শুনার অপেক্ষায় ছিলাম, আমি বললাম কি করছিস মায়া, হাত ছাড় কেউ দেখে ফেলবে, মায়া বললো আজ ধরা পড়েছো ময়না, নিজেকে যে আজ অজান্তেই প্রকাশ করলে, আর কত লুকাবে বলো, তোমার চোখে যে আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন, আর বুকের মধ্যে এক সমুদ্রের গভীর ভালোবাসা আমার জন্য লুকিয়ে রেখেছো, কিন্তু কেন মুখে একবার বলো না ভালোবাসি, আমি যে তোমার অপেক্ষায় বড় কষ্ট পাই। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি খুব আনন্দ পাও ময়না।
হঠাৎ আমার মায়া অভিমানে মুখ টা গোমড়া করে ফেললো, আমি মায়ার কপোল দুহাত স্পর্শ করে বললাম, ভালোবাসিতো, কিন্তু! মায়া অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে আমাকে বললো, কিন্তু কি ময়না, বললাম, বড় ভয় হয়ে রে মায়া, মায়া আরো বেশি উৎকন্ঠিত হয়ে বললো, কিসের ভয় পাও, আমি তোমায় ভালোবাসতে পারিনি, তোমার যোগ্য নই ময়না। তা নয় রে মায়া, তুই যে আমাকে কতটা ভালোবাসিস তা কেবল আমি ভালো জানি। আর তাই তো বকুল ফুলের মালা গেঁথে আমার জন্য অপেক্ষা করিস, আমি তোর মালা পড়তে চাইনি কারণ আমি জানি তোর আর আমার পরিবারের পার্থক্য। আমার দুঃখী মাকে নিয়ে অভাব অনটনের সংসার তোকে কি খাওয়াবো, মায়া মুখটা আরো বেশি গোমড়া করে বললো আমি কি অনেক খাই, তোমার মা জোড় করে খাওয়ায় আর না খেলে রাগ করে তাই খাই, আর তুমি ভাতের খোঁটা দিলে ময়না ভাই।
আমি চোখ টা বন্ধ করে নিরবে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, “আহহা রে কিশোরী সমাজ সংসার অভাব যে কি জিনিস তুই কি বুঝছি”।
হঠাৎ মায়া আমাকে ধাক্কা দিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো, ময়না তুমি কি ভাবছো আমি জানি, তোমার অভাবের সংসারে আমাকে বোঝা মনে করছো, ভয় নেই আমি তোমার সংসারে বোঝা হবো না, আমি তো সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিছি,
আমি বাড়িতে বসে সেলাই মেসিনে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করবো। আর তুমি ঢাকায় গিয়ে একটা কাজ জোগাড় করবে, দেখবে আমাদের ভালোবাসার সংসার খুব ভালো ভাবেই চলবে, তারপর অনেক টাকা জমা হলে বাড়িতেই একটা দোকান দিবে,
তুমি দোকান চালাবে আর আমি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করবো, আর শোন তুমি কালই ঢাকায় যাবে, আমার মামাতো ভাই যে ঢাকায় থাকে তার ঠিকানা তোমাকে দিব, আমি তাকে ফোন করে সব বলে রেখেছি।
আমি অবাক হয়ে মায়ার কথা গুলো শুনছিলাম, ভাবছিলাম এতটুকু মেয়ে এতসব পরিকল্পনা করলো কি করে, মায়া আমাকে আবার ধাক্কা দিয়ে বলবো, কি ভাবছো এতকিছু করছি কি করে, শোন ময়না, আমাদের মেয়েদের সংসার নিয়ে অনেক কিছু আগে থেকেই ভাবতে হয়, বলেই আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললো ময়না, তোমার পায়ে আমাকে একটু ঠাঁই দিবে না, বলেই পাগলী টা আমার পায়ে লুটিয়ে পড়লো, আমি ঝাপটে ধরে বললাম এই পাগলি একি করছিস, পাগলি টা বলছে, কেন ঠাঁই নাই আমার।
আমি বললাম না রে পাগলি, তোর জায়গা পায়ে নয় আমার বুকে, তারপর আলতো করে মায়াকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরে,
এক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম অপর হাতে মায়াকে বুকের আরো কাছে জড়িয়ে নিলাম। আর নিজের অজান্তেই কখন যে আমার অশ্রু তে পাগলিটার চুল ভিজে গেলো বুঝতেই পারলো না। কিন্তু আমি ঠিকই টের পেলাম মায়াবী পাগলিটা চোখের জলে আমার বুকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর বিড়বিড় করে বলছে ময়না সারাজীবন তোমার বুকে আমাকে আগলে রাখবে তো,
বললাম রাখবো তো, ধরেছি যখন আর ছাড়বো না, ছাড়বে না মানে, কেউ দেখে ফেলবে। ছাড়ো, আমি তো ছাড়ার বান্দা না,
একবার ধরেছি সারাজীবন জড়িয়ে ধরে রাখবো।
হঠাৎ মায়া বলে উঠলো ঐ দেখা মা আসছে, বলেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
হঠাৎ বিকট শব্দে আমার চেতনা ফিরে পেলাম দেখলাম আমাদের বাসের চাকা পান্চার হয়ে গেছে, কিন্তু আমার হাত টা আমার বুকের উপর রয়ে গেছে, সাথে আমার বুক পকেটে কিছু একটা আছে বুঝতে পারলাম। বের করে দেখি একটা নূপুর, নূপুরটা হাতে নিয়ে নিজের মনে হাসতে লাগলাম।তাতে পাশের লোকটা বললো কি রে ভাই পাগল হলেন নাকি। একা একা হাসছেন, হাতে আবার নূপুর,বাহ খুব আনন্দে আছেন, ভালো তো, বউয়ের পায়ের নূপুর নিয়েও মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করে আজ-কাল , কালকের ঈদের উপহার বুঝি। আমি বললাম নাহ, বউ এখন হয়নি তবে তাড়াতাড়ি হবে আরকি। বলেই নূপুর টা বুক পকেটে রেখে ভাবতে লাগলাম, ঢাকায় আসার সময় রাস্তার মাঝে মায়া তার একটা নূপুর দিয়ে বলছি ময়না আমার নূপুর টা নিয়ে যাও,
সবসময়ই বুক পকেটে রাখবে।
আমি বললাম কেন, মায়া বলছে ঢাকা শহরে যাচ্ছো কত সুন্দরী মেয়ে চোখে দেখবে, যদি আমার নূপুরটা তোমার বুকে থাকে তাহলে কোন মেয়েই তোমার বুকে বসতি স্থাপন করতে পারবে না, আর একটা আমার কাছে রাখছি আমার সিতানে রাখছি। আমিও তোমাকে ভুলবো না বুঝলে। এখন আল্লাহ নাম নিয়ে যাও, আর আমার নূপুরটা সাথে করে ভালো মত ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।
আমার পাশে বসা লোকটি বললো, ভাই চলুন নেমে পড়ি বাসের চাঁকা লাগাতে অনেক সময় লাগবে, আমরা বরং দেখি কোন দোকান আছে নাকি, চা বিড়িটিড়ি খাই। তারপর আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি, পাশেই একটা টং দোকানে চা বিড়ি খেতে শুরু করলাম, আচ্ছা ভাই আপনার পা এত ফোলা কেন, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ভাই গরীবের পোড়া কপাল, কদিন আগে কঠিন লকডাউনের সময় রিক্সা চালাইতেছিলাম। পুলিশ ধরে জরিমানা করলো, জরিমানার কোন টাকা দিতে পারিনি,
আমি বললাম স্যার জরিমানার টাকা দেব কোথায় থেকে পেটের দায়ে রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বেড় হইছি, তখন পুলিশ রাগের চোটে ইচ্ছেমত পিটনো শুরু করলো দুই পা জোরা করে, তাই এমন করে ফুলে গেছে, লোকটা আফসোস করে বলতে লাগলো, “কি কব রে ভাই সবাই শুধু গরীবের উপর ক্ষমতা দেখায়, আমাকেও মারছে, দেখেন” সে তার শার্টের বোতাম খুলে দেখালো, পুলিশ যেখানে মারছে ফোলা যায়গায় রক্ত জমে গেছে, বললো আমি ভাই ফেরিওয়ালা, ফেড়ি করে শাকসবজি বিক্রি করি।
আমাকে বললো, আপনাকে যে পুলিশ মারছে তা আপনার পরিবারের মানুষ জানে, আমি বললাম না রে ভাই এসব কথা কি সবাইকে জানানো যায়। তখন আমার মায়ার কথা মনে পরে গেলো, আমার এমন ফোলা পা টা যখন মায়া দেখবে তখন কি বলবো, সেই তো আমাকে আয় রোজগার করার জন্য এই ঢাকা শহরে পাঠাইছিলো, সে যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে করবে, খুব কষ্ট পাবে পাগলিটা। যাহোক পাগলি টা কে মিথ্যা করে হলেও একটা গল্প বানিয়ে বলবো, কিন্তু মাকে কি বলবো, মাকে মিথ্যা বলবো কি করে, মা কে তো কখনো মিথ্যা বলিনি, আবার যদি সত্যি টা বলি আর তো ঢাকায় আসতে দিবে না, যে করে হোক রিক্সা চালিয়ে হলেও কিছু টাকা জমিয়ে মায়ার দোকানের স্বপ্ন টা পূরণ করতে হবে। একটা সুন্দর ভালোবাসার সংসার গড়তে হবে।
পাশের লোকটা বললো ভাই চলুন বাসের হেলপার ডাকছে, বাসের চাকা লাগাইছে, তারপর বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো,
তারপর বাসের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন মায়ের কোলে ফিরবো, অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছে না। আমার মায়ের মুখ টা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই দেখলাম, এক মাস হলো মা কে দেখি না, দুঃখী মা আমার আমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে নিঃশ্চয়ই, মনের মধ্যে একটাই ভাবনা, মা আমার জন্য বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে আছে, আমি দৌড়ে গিয়ে মার পায়ে সালাম করলাম। তারপর মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, মার মুখের প্রথম কথা, আমার বুকে ধন কত দিন যে খায়না, ও ময়না তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি তোর জন্য ভাত রান্না করে রাখছি, তোর পছন্দের লাউ শাক আর কচুর পিটুলি দিয়ে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আয় বাপ। আমি হাতমুখ ধুয়ে এসেই খেতে বসলাম৷
মা আমাকে সেই ছোট বেলার মত করে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো, আর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো, কতোদিন মনে হয় পেট ভরে ভাত খাইতে পারিস নাই ময়না আমার। খা ময়না খা, পেট ভরে খা, আমিও মাকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলাম। আমি মা’র কোলে মাথা গুজে সুয়ে পড়লাম, আর মা আঁচলে আমার মুখ মুছতে মুছতে বললো ময়না ঢাকা শহরে আমাকে ফেলে একলা এতদিন থাকলি কি করে, মার কথা মনে পড়ে নাই, আর তোকে ঢাকা শহরে যেতে দিবো না বাবা এবার ঘরে বউ এনে তোকে বন্দী করবো, আমি লজ্জায় মার আঁচলে মাথা ডেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
হঠাৎ মানুষের আর্তচিৎকারে আমার ঘুম ভাঙলো, আমি দেখলাম আমার বুকের উপর একটা আস্ত একটা মোটাতাজা গরু চেপে আছে, আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে গরু টাকে সরানোর চেষ্টা করলাম, গরু টাকে এক চিমটিও সরাতে পারলাম না, গরু টা আস্তে আস্তে আমার মুখ চেপে ধরতে লাগলো, আমি শেষ বার চিৎকার করে মা কে ডাকতে লাগলাম, মা মা ওমা, তুমি কোথায়,
তোমার ময়না আজ বড় বিপদে পড়ছে, আমাকে তুমি বাঁচাও মা, আর বুঝি তোমার বুকে ফিরতে পারবো না, আর বুঝি তোমার হাতের মাখানো ভাত খেয়ে তোমার কোলে মাথা গুজে ঘুমাতে পারবো না মা।
মা মা ওমা তুমি কোথায়, তোমার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে মা, আমি যে চিরতরে তোমাকে ফেলে ঐ আকাশে চলে যাচ্ছি।
মা তোমার মায়াবী পবিত্র মুখ টা শেষ বার দেখতে পেলাম না, তোমার আদরের মায়া কে তোমার ময়নার বউ করে ঘরে তুলতে পারবে না মা। মা আমাকে তুমি ক্ষমা করো, তোমার কোন স্বপ্নই পূরণ করতে পারলাম না মা। ওমা মাগো কাল ঈদ, কাল আর তোমার হাতে পায়েস খেতে পারবো না, তোমার হাতে বুনানো টুপি পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারবো না। তোমার পায়ে সালাম করে দোয়া নিতে পারবো না। তোমার আঁচলের গিট থেকে চকচকে একটা দশ টাকার নোট পেয়ে তোমার কপালে একটা চুমু দিতে পারবো না। আর কোনদিন ভোরবেলায় আমার কপালে চুমু দিয়ে জাগিয়ে তুলে, ফরজ নামাজ পড়ার জন্য বলবে না মা।
তারপর কি কি ঘটে গেলো আমাকে নিয়ে জানি না। অতঃপর রাত গভীর হলো আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা বড়োই গাছের নিচে আমি নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে আছি, দেখলাম আমার পাশে আরো ক’টা মানুষ শুয়ে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়জন পুলিশ, তাড়া বলাবলি করছে, কতোগুলো লাশ থানায় নিয়ে গেলো আর যে ক’টা লাশ এখানে আছে সেগুলো কি করবো স্যার, তখন পুলিশের বড় সাহেব বলছে কি আর করবা, এগুলো এই জঙ্গলে তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দিয়ে দাও, তার মধ্যে একটা সাদা দাঁড়িওয়ালা বয়স্ক পুলিশ বললো, স্যার এই লাশ গুলো জানাজা নামাজ ছাড়া মাটি চাপা দেয়টা ঠিক হবে না।
তখন পুলিশের বড় সাহেব ধমক দিয়ে বলছে, বেশি বুঝনা, যা বলছি তাই শোন, এত বেশি মানুষ মরছে গাড়ি চাপা পড়ে, সব কিছু জানাজানি হলে আমাদের হাইওয়ে পুলিশের কত বদনাম হবে জানো, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে আমরাই অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়বো, তার চেয়ে ভালো তাড়াতাড়ি আপদ গুলো মাটিচাপা দিয়ে ঝামেলা মুক্ত করো। তারপর বয়স্ক পুলিশ টা আমার কাছে এগিয়ে এলো, তারপর বড় পুলিশের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, স্যার একটা লাশ শাড়ি দিয়ে প্যাচানো, মনে হয় বয়স্ক মহিলাদের শাড়ি, মনে হয় ছেলেটা মায়ের জন্য ঈদের শাড়ি কিনেছিলো, অন্তত এই ছেলেটার লাশটা তার মায়ের কাছে পৌঁছানো উচিৎ, তখন পুলিশের বড় সাহেব বললো, বেশ আরো ভালো হয়েছে, ওটা দিয়েই কাফনের কাপড় হিসাবে ব্যবহার করে, ওটা কে আগে মাটি চাপা দাও, বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।
বয়স্ক ব্যক্তিটি তখন চুপ করে দাড়িয়ে ছিলো। তখন পুলিশের বড় সাহেব তাকে এমন করে বিকৃতভাষ্যে ধমক দিলো, আমিও ভয় পাইলাম। তারপর মনে পড়ে গেলো ঢাকা শহর থেকে মার পছন্দের জাম কালারের শাড়িটা কিনেছিলাম। বাসের মধ্যে বসে যখন মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো, তখন মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেখছিলাম, জাম রঙের শাড়ি টা পড়লে মা কে দেখতে কেমন লাগে, আর মায়ের জন্য কেনা নতুন শাড়িতে আমার মায়ের আদরের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। আর মায়ের আঁচলের গন্ধ পেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর কখন যে আমাদের বাসটাকে গরু বোঝাই ট্রাক এসে চাপা দিয়ে কত মানুষকে মেরে, সব স্বপ্ন চাপা দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো, আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না।
কিছুক্ষন পর বয়স্ক ব্যক্তিটি আমার দিকে আবার এগিয়ে এলো, তারপর আমার মুখের উপর আলতো করে হাত বুলালো, অতঃপর আমার খোলা চোখ টা বন্ধ করে দিলো, আমি আর কিছুই দেখতে পেলাম না, চার দিকে শুধুই অন্ধকার!