আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে সন্তানকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফেরার আকুতি জানিয়ে যাচ্ছেন শামীমা। এদিকে শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে উঠে আসছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বলা হচ্ছে, মা-বাবা সূত্রে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। যদিও শামীমা দাবি করেছেন, তিনি বাংলাদেশে কখনো ছিলেন না।
বুধবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, হোয়াইট হল জানিয়েছে যে ১৯ বছর বয়সী শামীমা এখন অন্য দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযোগী। এ অবস্থায় তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব।
তবে শামীমার পরিবারের আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জে বলেছেন, ব্রিটিশ সরকারের এমন সিদ্ধান্ত তাঁদের ‘হতাশ’ করেছে। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে ‘সব আইনি পথ’ খতিয়ে দেখছেন তাঁরা।
শামীমা বেগম ২০১৫ সালে পূর্ব লন্ডন ছেড়ে আইএসে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। গত সপ্তাহে তাঁকে সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে পাওয়া যায়। তিন দিন আগে তিনি একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন।
গত সোমবার বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, তিনি কখনো আইএসের ‘পোস্টার গার্ল’ (প্রচারের জন্য ব্যবহৃত মেয়ে) হতে চাননি। এখন তাঁর একটাই সাধারণ চাওয়া, সন্তানকে যুক্তরাজ্যে বড় করা।
শামীমার মায়ের কাছে ব্রিটিশ সরকারের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর মেয়েকে জানাতে যে তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আইটিভি নিউজের সংগ্রহে চিঠিটির একটি কপি রয়েছে।
ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, একজন ব্যক্তি নাগরিকত্ববঞ্চিত হতে পারে যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন যে এটা ‘জনস্বার্থের জন্য সহায়ক’। তবে ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হতে পারবেন না।
শামীমা জানান, তিনি তাঁর বোনের ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিলেন। তবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর তাঁদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়।
শামীমাকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বলা হলেও বিবিসির সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেছেন, তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেই এবং তিনি কখনো বাংলাদেশে ছিলেন না।
সন্ত্রাসবিষয়ক আইন পর্যবেক্ষক লর্ড চার্লি বলেছেন, শামীমা বেগমের মা যদি বাংলাদেশি হয়ে থাকেন, তবে বাংলাদেশি আইন অনুসারে শামীমাও বাংলাদেশি।
এদিকে শামীমার নবজাতক ছেলের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আগে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তানকে ব্রিটিশ নাগরিক বলে বিবেচনা করা হবে। তবে সম্ভাব্য কোনো ঝুঁকির কথা তুলে ধরে সেই শিশুরও নাগরিকত্ব একসময় বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ বলেছেন যে ব্রিটেনে বসবাসরত মানুষের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং শামীমার পরিবারের বন্ধু ডাল বাবু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠির ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন ‘চটজলদি প্রতিক্রিয়ায়’ তাঁরা ‘খুবই অবাক’ হয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘শামীমা কখনো বাংলাদেশে ছিল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে অবাস্তব মনে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না, এটা কীভাবে আইনিভাবে দাঁড়াবে।’
আইএস তাদের নিয়ন্ত্রিত বেশির ভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তবে ইরাকের সঙ্গে সিরিয়ার সীমান্তে ৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার আইএস জঙ্গি রয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমপিদের জানিয়েছেন, আইএসের সমর্থনে দেশে ছেড়েছেন—এমন দ্বৈত নাগরিকদের ১০০ জনের বেশি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। গত বছর দুই ব্রিটিশ পুরুষ আইএসের সদস্য অভিযোগে সিরিয়ায় আটক হওয়ার পর তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যে আবার ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে শামীমা বলেন, সিরিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনো দুঃখবোধ নেই। আইএস যোদ্ধারা জিম্মিদের শিরশ্ছেদ করছে—এমন ভিডিওর পাশাপাশি আইএস-প্রদর্শিত ‘সুন্দর জীবন’-এর ভিডিও দেখে তিনি কিছুটি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে আইএস যা করেছে, তার সবকিছুর সঙ্গে তিনি একমত নন।
শামীমা বলেন, ‘আমি আসলে ব্রিটিশ মূল্যবোধের পক্ষে কাজ করেছি। আমি যুক্তরাজ্যে ফিরে আসতে চাইছি। যুক্তরাজ্যে আবার বাস করতে চাই, পুনর্বাসিত হতে চাই।’
শামীমা স্বীকার করেন, ২০১৭ সালে ম্যানচেস্টার এরেনা হামলায় ২২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি ‘বেদনাহত’ হয়েছিলেন। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল আইএস। তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করি, এটা ভুল। নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।’
তবে একই সঙ্গে সিরিয়ায় সামরিক হামলার তুলনা করে বলেন, ‘একজন সৈন্যকে হত্যা করা হলে ঠিক আছে, আত্মরক্ষার জন্য তা করা হয়েছে।’ সিরিয়া যোদ্ধারা আইএসের নারী ও শিশু হত্যা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাঘুজে নির্বিচারে বোমা মেরে আইএসের নারী ও শিশু হত্যা করা হচ্ছে। এটি এখন দুই দিকের ব্যাপার। কারণ, আইএসেও নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে।’
শামীমা আরও বলেন, ‘এটা একধরনের প্রতিশোধ। তাদের যুক্তি ছিল যে এটা প্রতিশোধ, তাই আমি ভেবেছিলাম, ঠিক আছে, এটা ন্যায্য।’
শামীমার এমন মন্তব্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। ম্যানচেস্টার এরেনা হামলায় গুরুতর আহত রবি পটার নামের এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি শামীমার মন্তব্যে ‘ ক্ষুব্ধ’ এবং ‘অসুস্থ’ বোধ করেছেন। তিনি বলেন, ওই হামলায় মানুষ তার সন্তান হারিয়েছে, পরিবারের সদস্য হারিয়েছে। এটা দেখে তাদের কী অনুভূতি হবে। আমরা কি এমন একজনকে ফিরিয়ে আনাকে মেনে নিতে পারব?’
রবি পটার ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘আসুন, তাঁকে ফিরে আসতে দিই এবং যাঁরা সন্তান হারিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে দিই তাঁকে। এটাই বোধ হয় তিনি চান। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে এক কক্ষে গিয়ে দেখুন তাঁদের ন্যায্যতার ফল?
শামীমার সঙ্গে তাঁর স্কুলের দুই বন্ধু খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্য ছেড়ে যান। খাদিজা সুলতানা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আমিরা আবাসে ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানা যায়নি।
তিন দিন আগে শামীমা ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। এর আগেও তিনি দুবার মা হয়েছিলেন। তবে সেই সন্তানেরা বাঁচেনি। তাঁর স্বামী ডাচ্ নাগরিক, নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়া যোদ্ধাদের লড়াইয়ে শামীমার স্বামী আত্মসমর্পণ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্টনি লয়েড সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় একটি শরণার্থীশিবিরে সাক্ষাৎ পান শামীমার। ওই সাংবাদিককে শামীমা বলেন, তিনি নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এখন যেকোনো দিন তাঁর সন্তানের জন্ম হতে পারে। এর আগে অপুষ্টি আর রোগে ভুগে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। নবাগত সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরতে চান। তবে আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত নন বলে জানান।
সূত্র : নিউজ ২৪