গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আজ ফজরের নামাজের পর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হকের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চার দিনব্যাপী এই ইজতেমা। ময়দানে বয়ান, জিকির ও তালিমে মগ্ন মুসল্লিরা।
তবে এর আগে বুধবার রাতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইজতেমা ময়দানে জড়ো হয়েছেন মুসল্লিরা। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে ইজতেমা ময়দান।
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সাদ অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সংঘর্ষ নিয়ে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমঝোতা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উভয় অনুসারীদের পৃথক ব্যবস্থাপনায় দুদিন করে টানা চার দিন অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম দুদিনের ইজতেমায় মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা এবং পরবর্তী দুদিন মাওলানা সাদ অনুসারীরা অংশ নেবেন। এ উপলক্ষে ইজতেমা ময়দানের প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল।
একদিন আগেই শুরু
গত বুধবার রাত থেকে দলে দলে মুসল্লিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকে জোবায়ের অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমার বয়ান শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খুরশিদ এ বয়ান করেন। বয়ান তর্জমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. জাকির হোসেন। বাদ মাগরিব শুরু হয় ইজতেমার আমবয়ান। আমবয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট। আমবয়ান তর্জমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক। প্রতিবছর আমবয়ান দিয়েই বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়। শনিবার দুপুরের আগে সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে যেকোনো সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ পক্ষের বিশ্ব ইজতেমা। পরে শনিবার রাত ১২টার মধ্যে তারা ইজতেমাস্থল ত্যাগ করবে।
পরদিন রোববার ১৭ ফেব্রুয়ারি বাদ ফজর শুরু হবে সাদ অনুসারীদের ইজতেমার কার্যক্রম। ১৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে। এবার ইজতেমায় থাকছে না কোনো ধাপ বা পর্ব।
এবার বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লি এরই মধ্যে ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। এ ছাড়া মুসল্লিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে। এবার বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লি। তাঁরা ময়দানের তাঁবুর নিচে ৫০টি খিত্তায় বসে ইজতেমার মুরব্বিদের বয়ান শুনবেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে কয়েক লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। এ ছাড়া মুসল্লিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে। এখানে বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরাও রয়েছেন। মুসল্লিদের সুবিধার্থে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে এবারের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হোক, এটাই সবার প্রত্যাশা।
বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, টঙ্গীর তুরাগতীরে ১৬০ একর বিস্তৃত বিশ্ব ইজতেমা ময়দান প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা অবস্থান নিয়েছেন তাঁদের নির্ধারিত তাঁবুর নিচে। তাঁরা জিগির-আজগার এবং আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এসব মিলিয়েই টঙ্গীর তুরাগতীর যেন মুসল্লিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর, তরুণসহ সব বয়সের মুসল্লি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ও টুপি মাথায় ইসলামের এ মেলায় শরিক হয়েছেন। ইজতেমা ময়দানে যতটুকু চোখ যায়, শুধু দেখা মিলে টুপি-পাঞ্জাবি পরা মুসল্লিদের। মাথার ওপর চটের তাঁবু, নিচে সবুজ ঘাস।
গত জানুয়ারিতে ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে সংঘর্ষের পর ইজতেমা অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যায়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় দুই মুসল্লি নিহত ও পাঁচ শতাধিক মুসল্লি আহত হন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে স্থানীয় সাংসদ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দুপক্ষকে একসঙ্গে এনে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের কার্যক্রম শুরু করেন।
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বিআরটিসি মুসল্লিদের আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইজতেমা মাঠের সংস্কারকাজ এবং সেবামূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে। বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য ইজতেমা মাঠে পাঁচটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র্যাব, আনসার ও ভিডিপির কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার, র্যাবের ১০টি ওয়াচ টাওয়ার, মুসল্লিদের জন্য ৩৫০টি অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণ, অজু, গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ১৩টি গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন তিন কোটি ৫৪ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আকাশ ও নৌপথে পুলিশ, র্যাবের নিয়মিত টহল। নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে টঙ্গী শিল্পনগরী পুরো শহরটিকে।
দুই মুসল্লির মৃত্যু
এদিকে, বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসা দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. জব্বর আলী ওরফে রাজ্জাক (৪২) ও নাটোরের মোহাম্মদ আলী (৫৫)।
ইজতেমার মাজলেহাল জামাতের জিম্মাদার মো. আদম আলী জানান, বুধবার ভোররাত ৩টার দিকে ও বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে তাঁরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে ও দুপুরে ইজতেমা ময়দানে জানাজা শেষে তাঁদের লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র : এন টি ভি