ঢেঁকি একটি বাংলা শব্দ কিন্তু এই প্রজন্মের কেউ জিনিষটি কি জানতে চাইলে গুগল সার্চ করতে হবে। আদি বাংলায় ঢেঁকি নামটির সঙ্গে বহু ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই ঢেকি ছিল। প্লেনের আকৃতির একটি মোটা কাঠের মাথায় মোটা গোলাকৃতির একটি কাষ্টখন্ড ৯০ ডিগ্রীতে লাগানো। কাষ্টখন্ঠেটির মাথায় গোল করে লোহার পাত মোড়ানো। পেছনের দিকে ঢেকি ছিদ্র করে এক টুকরো কাঠ দিয়ে দুই পাশে খুটির উপর ব্যলেন্স করে রাখা হয়। মাথার সামনে গোলাকৃতির দন্ডটি ঢেঁকিকে গর্তে দাড় করিয়ে রাখে। সেই গর্তে একটি লোহার বাটির মত পাত্র বসিয়ে মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া হয়। গর্তে ধান রেখে পেছনে থেকে পা দিয়ে চাপ দিলে মাথাটি উপরে উঠে যায়। ছেড়ে দিলে শব্দকরে গর্তে পরে। এভাবেই ধান বানা হত আগে। কিষান জমিতে ধান ফলাত আর কিষানীরা ধান বানত ঢেঁকিতে। ধান থেকে চাল বের করেই রান্না হত- তখন ধান ভাঙ্গার মেশিন ছিলনা। বছর ধরে বাড়ীতে ধান ভাঙ্গা হত, ঢেকির শব্দ শোনা যেত চলাচলে। ঢেকিতে ধান বানার কৌশল আছে, সামনের মাথাটি উঠে গেলে পরার আগেই হাত দিয়ে ধান বা চাল নেড়ে দিতে হয়। সময়ের হিসাব ভুল হলে হাত থেতলে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। গ্রামাগঞ্জে এখনো ঢেঁকির সন্ধান পাওয়া যাবে। গ্রাম বাংলার পিঠা পার্বনেও ঢেঁকি ব্যবহার হত চাল ভাঙ্গতে। দৃশ্যটি হারিয়ে গেছে, উৎসবও বদলে গেছে আধুনিকতার ছোয়ায়। বিবর্তন জরুরী তবে, দেশের সংস্কৃতিটি হারিয়ে যাওয়ায় শেকড়টি ভুলে গেছে অনেকে।
এখন আমরা যে চালের ভাত খাই তা মেশিনে ভাঙ্গে আবার অন্য একটি মেশিনে চিকন করা হয়। ফলে চালের অর্ধেক সাধ আর থাকেনা। চিকন চালের চাহিদা বেশী তাই, স্বাধের কথাটি কেউ আর ভাবেনা।আগে বরিশালের বালাম চাল পাওয়া যেত খুবই চিকন আর সুসাধু। দিনাজপুরের কালিজিরা চাল ছিল সুগন্ধি। ঢেঁকিছাটা চালের স্বাধও ছিল অসাধারন। এখন ইরি ধানের মোটা চাল কাটিং করে বিভিন্ন রকম নাম দেওয়া হয়। সার দিয়ে উৎপাদিত ধানের চাল দেশের খাদ্য ঘাটতি কমিয়েছে কিন্তু স্বাধটি হারিয়ে গেছে। এখন নাকি প্লাষ্টিকের চালও আবিস্কার হয়ে গেছে। এই বিবর্তন স্বাধের সাথে খাবারের ঐতিহ্যটিও বিলিন করে দিয়েছে।ভাত-মাছের পরিবর্তে এখন বার্গার আর পিজ্জা এসে গেছে। চাইলে বাংলাদেশী খাবারকে আধুনিকরন সম্ভব ছিল, তা নাকরে বিদেশী খাবারকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। এভাবেই সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে দেশে। ভাষা, খাদ্য আর সংস্কৃতি দেশের ঐতিহ্যকে বদলে দিয়েছে। বাংলার জন্য যে দেশে প্রান দিয়েছে, সেদেশের এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বাংলা বলে ইংরেজীর মত করে। বাংলার চেয়ে ইংরেজীর কদর বেশী হয়েগেছে। নেতৃত্বকে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার। তা নাহলে একদিন বাংলা ভাষাটিও মিশ্র ভাষায় পরিনিত হয়ে যাবে।
আজিজুর রহমান প্রিন্স
টরন্টো, কানাডা
৩ অক্টোবর ২০২০।