আমার এক চাচা ছিলেন ফজলু মাতবর। লেখাপড়া করেছেন মাদ্রাসায় তাও কিছুদিন। সুন্দর উচ্চারনে ইমামতিও করতেন। একবার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন গ্রামের মধ্যমনি, সব কাজেই তার ডাক পরত। আমার দেখা বিচক্ষন মানূষদের একজন ছিলেন ফজলু মাতবর। আর্থিক অবস্থাটি ভাল ছিলনা, কৃষি কাজ করেই সংসার চালাতেন। ক্ষেতে মালকাছা দিয়ে কাজ করার সময়ও দেখা যেত কিছু মানূষ ক্ষেতের আইলে বসে হুক্কা টানছে আর কথা বলছে মাতবরের সংগে। এমন মানূষেরা একা থাকতে পারেনা, সন্ধা হলেই ফজলু মাতবরের বৈঠকখানায় আড্ডা বসত গ্রামের মানূষের। হুক্কার গুর গুর শব্দ আর তামাকের গন্ধে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠত। এই ঘরের ভাংগা চেয়ারে বসেই গ্রামের নানা বিষয়ে আলোচনা হত। কার মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হল, কার ছেলের বিয়ে কিংবা খতনা হবে তা ফজলু মাতবরের এই ঘরেই সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হত। খালী গায়ে লুংগি পরে চেয়ারে এক পা তুলে হুক্কায় টান দিয়ে ধুয়া ছেড়ে সিদ্ধান্ত দিতেন ফজলু মাতবর। মাঝে মাঝে কিশোর আর যুবকরাও উপস্থিত হত ঐ বৈঠকখানায়, মাতবর তাদের কাছেও ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। কারনও ছিল, ফজলু মাতবর চোখ বন্ধ করে যা বলতেন তা আসলে শোনার মতই। একদিন এমনই এক আড্ডায় ফজলু মাতবর বললেন ” যদি উদার হতে চাও তাহলে আকাশের মত হও যেন, সমস্ত পৃথিবীর মানূষ তোমার ছায়া পায়। আর যদি পবিত্র হতে চাও তাহলে, সাগরের মত হও যেন, কাকের মত পাখী ময়লা খেয়ে ঠোট ভিজালে পানি ময়লা না হয়”। বাড়ী ফিরে কথাটির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেছি। অবাক হয়েছি কথাটির মর্মাথ অনুমান করে। প্রায়ই শুনি লোকেরা সমালোচনা করেন গনমাধ্যমে।নীজের ভাবনাকেই সমাধান ভেবে প্রকাশ করেন যুক্তি দিয়ে। এমন বক্তাদের ভাবনায় প্রত্যাশাটি লক্ষ্যনীয়, উদারতাটিও নেই। বক্তব্য শুনে সততাটিও বোঝা যায়না। সবকিছুতেই রাজনীতি টেনে আনে, দোষটি কেবল সরকারের। সুযোগ পেলে নীজেরাই অপরাধ করেন দায়ি করেন রাজনীতিকে। যারা সব বিষয়ে রাজনীতিকেই দায়ি করেন, তারা আসলে কৌশলী। রাজনীতি সেই শিক্ষা দেয়না। বাংলাদেশেও যথেষ্ঠ প্রমান আছে সুস্থ্য রাজনীতির। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, নিজেও ভাল উপার্জন করেছেন আইন পেশায় কিন্তু অর্থ সংকট হয়েছে তারও। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি বাস করতেন বেড়ার ঘরে। আট্টালিকার স্বপ্ন দেখেননি, জাতীর জনক বংগবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান সরকারী বাড়ীতেও থাকেননি, সাধারন জীবন যাপন করেছেন। এই নেতাদের লক্ষ্য ছিল একটাই দেশ এবং দেশের মানূষের জন্য একটি সমৃদ্ধশালী জাতী বিনির্মানের। সূখ স্বাচ্ছন্দকে পরিত্যগ করেছেন জীবনের ব্রত হিসাবে। পবিত্রতায় দাগ লাগতে দেননি, উদার ছিলেন আকাশেরই মত। সেই ছায়াতলেই বাংলাদেশ আজ গর্বীত জাতী। দূটি হাত যতটুকু বিস্তৃত হয় সেই পরিধিটুকু স্বচ্ছ আর পবিত্র রাখলেই এখন দেশ সেবা করা যায়, পবিত্রও রাখা যায় নিজেকে। এখন যারা প্রতিদিন আলোচনায় অন্যকেই দায়ী করি তারা কি বুকে হাত রেখে নিজেকে পবিত্র দাবী করতে পারবেন? যদি এই সাহস না থাকে তাহলে আপনি যত বড়ই হন পবিত্র নন। ফজলু মাতবরের উক্তিটিই আমাদের একবার ভাবা উচিত।
আজিজুর রহমান প্রিন্স
রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক
টরেন্টো, কানাডা
২২ জুলাই ২০২০।