আমার একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি আপাদমস্তক ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। স্যারের চলন, বলন আর শুদ্ধ উচ্চারন মুগ্ধ করত সকলকে। ক্লাশে P B Shelly এর The Cloud কবিতাটি পড়াতে গিয়ে প্রকৃতির বর্ননা দিয়েছেন অসাধারন ভংগিতে। মনে হত যেন তিনিই লিখেছেন কবিতাটি। পিনপতন নিস্তব্দতায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছি স্যারের দিকে যেন, সেক্সপিয়ারের Othello নাটকের অভিনয় মঞ্চায়ন দেখছি। মুনির চৌধুরীর সহপাঠি ছিলেন স্যার, বহু গল্প শুনিয়েছেন মুনির চৌধুরীকে নিয়েও। একদিন ক্লাশে স্যার একটি গল্প বলছিলেন এই রকম। জগন্নাথ কলেজ তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। শৈলেন ভদ্র নামে একজন সুদর্শন ইংরেজী শিক্ষক ছিলেন যিনি একজন নাট্যাভিনেতাও। এই শিক্ষক প্রতিদিন কলেজ থেকে কুলির মাথায় করে কিছু বই নিয়ে বাসায় ফিরতেন, রাতে পরদিন কি পড়াবেন তা নীজে পড়ে ক্লাশে যেতেন। বই নিলেও একরাতে বন্ধুর নিমন্ত্রন রক্ষা করতে গিয়ে পড়াশুনা করতে পারেননি, প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাশে চলে গেছেন। একটা কবিতা পড়াচ্ছিলেন সেদিন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন কবিতায় একটি শব্দ রয়েছে যার অর্থ তিনি জানেননা। সাধারনত তিনি দ্রুতই পড়ান কিন্তু, সেদিন আস্তে আস্তে পড়াতে লাগলেন যাতে শব্দটি আসার আগেই বেল বেজে যায়। ভাগ্য খারাপ, বেল বাজলোনা তাই শব্দটি এড়িয়ে অন্য শব্দে চলে গেলেন। তখনই ঘটলো ঘটনাটি। একজন ছেলে দাড়িয়ে শব্দটির অর্থ জানতে চাইলো। মুহুর্তেই শৈলেন ভদ্র তার চেহারাটি পাল্টে ফেললেন।যাত্রার নায়কের মত ক্ষুদ্ধ হয়ে বলে উঠলেন ” এই শব্দটির অর্থ জানোনা আর চলে এসেছো কলেজে পড়তে? যাও! আজ আমি আর পড়াবোনা, বলেই বইটি টেবিলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন ক্লাশ থেকে। হতবাক ছাত্রছাত্রীরা নির্বাক তাকিয়ে থাকলো, কেউ কেউ সেই ছেলেটিকে কথাও শোনালো অনেক। পরদিন শৈলেনভদ্র ক্লাশে গেলেন, রোল কল করে বই হাতে নিয়ে সেই ছেলেটিকে দাড়াতে বললেন। ছেলেটি ভয়ার্ত চেহারায় দাড়িয়েই বললো ” স্যার আমি আজ শব্দটির অর্থ জেনে এসেছি”। শৈলেন ভদ্র কিছুক্ষন চুপ থেকে বইটি টেবিলে রেখে করো জোড়ে দাড়ালেন, বললেন। তোমরা আমাকে মার্জনা করো। পরশু রাতে আমি একটি নিমন্তন্ন রক্ষা করতে গিয়ে ফিরে এসে আর পড়ার সময় পাইনি, শুয়ে পরেছিলাম। শব্দটির অর্থ আমারও জানা ছিলনা। শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের কাছে ধরা পরে যাবো, সেই ভয়ে আমি অভিনয় করেছি। বড় বেশী অন্যায় হয়ে গেছে আমার। তোমরা আমাকে মার্জনা করো, বলেই ডুকরে কেঁদে ফেললেন। গল্পের বাকীটা আর লেখার প্রয়োজন অনুভব করছিনা তবে, সেই শব্দার্থ না জানা ছেলেটি সে বছর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীনে অনূষ্ঠিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। বাস্তব জীবনে আমরা সকলেই কমবেশী অভিনয় করি, কখনো প্রয়োজনে আবার কখনো প্রয়োজন ছাড়াই। রাজনীতির অভিনিয়টি ধরাও যায়না। দক্ষ অভিনয় শিল্পী রাজনীতিবিদরা। মানুষকে অনুপ্রানিত করার কাজটি সহজ নয়, রাজনীতিবিদরা কথার অভিনয় দিয়েই সেই কঠিন কাজটি করেন। রাজনীতির নামেও অভিনয় করে অনেকে। অভিনয় করে জনদরদি সেজে লুটে নেয় জনগনের সম্পদ। রাজনীতি অনুকরনের অভিনয় করেই এরা সম্পদশালী, বিত্ত্ববান। এই অভিনেতারা রাজনীতির অভিনয় করে রাজনীতি করেনা। মিথ্যাচার বিলিয়ে অসৎ অযোগ্য লোকেরা ধনী হতে পারে, রাজনীতি বোঝেওনা রাজনীতি করেওনা। অসত্যের ভিড়ে সততা এখন অবাঞ্চিত হয়ে গেছে রাজনীতিতে। শৈলেন ভদ্রের মত সত্য স্বীকার করার সাহস আর যোগ্যতা এই অভিনেতাদের নেই।
আজিজুর রহমান প্রিন্স
রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক
টরেন্টো, কানাডা
২১ জুলাই, ২০২০।