২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। আর বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ফলে অনুদানসহ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
এটি দেশের ৪৯তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের দ্বিতীয় বাজেট উপস্থাপন।
বৃহস্পতিবার (১১ জুন) বিকাল ৩টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্য শুরু করেন। এ বাজেট বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ সম্পন্ন হলো।
এটি মূলত সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যায় প্রস্তাব। এই বাজেটে বরাবরের মতোই সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জনপ্রশাসন খাতে। সরকারের বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন প্রদানেই এই টাকার সিংহভাগ চলে যায়।
প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। চলতি বছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।
একক খাত হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ। আগামী অর্থবছরের জন্য এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
এরপর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৭৭ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৪০ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা।
৩৪ হাজার ৮৮২ কোটি বরাদ্দ পেয়েছে প্রতিরক্ষা খাত। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা।
জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৭ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে আগের যে কোনো বছরের তুলনায়। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে রয়েছে ২৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও আগামী বাজেটের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৩২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
আইন ও বিচার বিভাগের জন্য পরিচালন ও উন্নয়ন খাত মিলিয়ে ১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য পরিচালন ও উন্নয়ন খাত মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৪.৬ শতাংশ কম। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা।
এছাড়া গৃহায়ণে ৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্মে ৪ কোটি ৭৮৬ টাকা, কৃষিতে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে ৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মাথা পিছু বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৭৭১ টাকা। চলতি বছর মাথা পিছু ঘাটতি ছিল ৮ হাজার ৯৯০ টাকা। এছাড়া মাথা পিছু বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ কর্মসূচীর বরাদ্দ ১২ হাজার ৬৮৬ টাকা। চলতি অর্থবছর যা ছিল ১২ হাজার ৩৩৬ টাকা।
অন্যদিকে চলতি বছরে দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এই পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার ২৬৫ টাকা। এ হিসাবে বাজেটে ব্যয় হচ্ছে আয়ের ২২ শতাংশেরও কম। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় যা একেবারেই সামান্য।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া, দেশ থেকে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং এবং ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির প্রবণতা রোধ করতে যে পরিমাণ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে পাচার করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে তার উপর ৫০ শতাংশ হারে করারোপ করা হবে বলে বাজেটে ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে যা–ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।
এ ছাড়া একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাগণ পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে, আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না।
এ বছর বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে দীর্ঘ ৫ বছর পর করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করপোরেট ট্যাক্স ২.৫ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে করপোরেট ট্যাক্সের হার কমানো হলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, মোবাইল অপারেটর ও সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ট্যাক্সহার অপরিবর্তিত থাকছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে বাজেটে টার্নওভার ট্যাক্সের হার কমানো হয়েছে। এটি ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির সীমা আগের মতোই ৫০ লাখ টাকা এবং টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা ৩ কোটি টাকা রয়েছে। তবে সব শ্রেণির ব্যবসায় নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
পোশাকসহ সব ধরনের রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে উৎসে কর কমানো হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজাটে রফতানি মূল্যের ওপর দশমিক ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির কারদাতাদের জন্য তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর করহার শূন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরবর্তী এক লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ, তার পরবর্তী তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, তার পরবর্তী চার লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, তার পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ এবং তার বেশি টাকা আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ আয়কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকার অধিক স্থিতির উপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ১০ লাখ টাকার অধিক হতে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবে আমানতের স্থিতির আবগারি শুল্ক দুই হাজার ৫শ থেকে বৃদ্ধি করে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। ১ কোটি টাকার বেশি হতে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতি হিসাবের আবগারি ১২ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার অধিক স্থিতির হিসাবে ২৫ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেন।
তবে অপরিবর্তিত রয়েছে, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত স্থিতির আবগারি শুল্ক।