শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও তদন্ত করে কেনাকাটায় দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপরই জড়িতদের ধাপে ধাপে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত ২২ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) আবু হেনা মোরশেদ জামানকে পদায়ন করা হয়।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে দিয়ে তার স্থানে সচিব করা হয়েছে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানকে।
সরকারি সূত্রমতে, ধাপে ধাপে দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে চায় সরকার। তাই আগামীতে স্বাস্থ্য খাতে আরও রদবদল হতে পারে।
দুর্নীতির শুরু যেভাবে-
এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রথমে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটার দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন-৯৫-এর মোড়কে করে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করে সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানানোয় খুলনার পরিচালককে পাবনা মানসিক হাসপাতালে বদলি এবং মুগদার পরিচালককে ওএসডি করা হয়।
সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তারা এন-৯৫ মাস্কের কোনও কার্যাদেশ জেএমআইকে দেয়নি। অথচ সিএমএসডি থেকে ওই সব প্রতিষ্ঠানে পাঠানো সামগ্রীর তালিকায় জেএমআইর এন-৯৫ মাস্কের কথা উল্লেখ করা হয়। গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়।
সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালকের জনপ্রশাসনের সচিবকে লেখা চিঠিতে উঠে আসা তথ্য-
সিএমএসডি পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে চিঠিতে তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং সিএমএসডি কী কী কেনাকাটা করবে, সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কখনোই সঠিক কোনো পরিকল্পনা করেনি। সিডিসি কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সিএমএসডি নিজস্ব উদ্যোগে পিপিইসহ অন্যান্য সামগ্রী মজুদ করতে থাকে। পরে ১০ মার্চ সিডিসি পরিচালক সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১৫ কোটি টাকার একটি চাহিদা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের (বাজেট) মৌখিক নির্দেশনায় সিএমএসডি সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়বাবদ ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। মার্চ মাসের দিকে এই টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে সমস্ত ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
আনুমানিক ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটার কথা উল্লেখ করে পরিচালক আরও বলেন, এ পর্যন্ত আনুমানিক ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটা হলেও মাত্র ১০০ কোটি টাকার সংস্থান করা হয়েছে। বারবার বাকি অর্থের চাহিদার কথা জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও অর্থছাড় করা হয়নি। এ কারণে সরবরাহকারীদের বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
কেনাকাটায় সিন্ডিকেট-
সিএমএসডির ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিবি ল্যাপ্রোসি ও এসটিডি এইডস কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম এবং পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবিরকে ক্রয় প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সামিউল ইসলামকে করোনা-সংক্রান্ত সিএমএসডি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্রয় প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব করা হয়। তবে তিনিই ছিলেন মূল সমন্বয়কারীর ভূমিকায়।
তবে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে অধিদপ্তরের এই সিন্ডিকেটের সখ্য ছিল। তাদের মাধ্যমেই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দেখানো হয়েছে। একসেট এক্সামিনেশন হ্যান্ড গ্লাভসের দাম দেখানো হয়েছে ৩৬ টাকা। অথচ ৫০ জোড়া এ ধরনের গ্লাভসের বাজারমূল্য মাত্র ১৮০ টাকা। ১২০ থেকে ২৫০ টাকা মূল্যের রেইনকোর্ট জাতীয় পণ্য কিনে পিপিই বলে হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে। পিসিআর মেশিন ক্রয় করা হয়েছে পুরোনো ২০০৯ সালের মডেলের। ওই মেশিনের মান নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে দুটি হাসপাতালের পরিচালকও অভিযোগ করেছেন।
একধিক সূত্র বলছে, ৯০০ কোটি টাকা কেনাকাটার কথা বলা হলেও তার অর্ধেক পরিমাণ টাকার সামগ্রীও কেনা হয়নি। বাড়তি মূল্য দেখিয়ে ঠিকাদারদের সঙ্গে জোগসাজশে টাকা লোপাট করা হয়েছে।
দাতাগোষ্ঠীর অর্থ লোপাটের ছক-
করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বড় ধরনের আর্থিক ঋণ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকা, আর সরকার দিচ্ছে ২৭৭ কোটি টাকা। এডিবির অর্থায়নে অপর একটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবি ৮৫০ কোটি টাকা আর সরকার বাকি ৫১৫ কোটি টাকা দেবে। এই প্রকল্প দুটি ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদন হয়েছে। কেনাকাটার প্রক্রিয়াও শুরু হতে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই ক্রয় করা হবে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রত্যেকটি পিপিই ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। এক লাখ সেফটি গগলস ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। প্রতিটি গগলসের দাম পড়বে পাঁচ হাজার টাকা করে। ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট ক্রয়ের জন্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে প্রত্যেকটির দাম পড়বে এক হাজার ৫০০ টাকা করে। সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, প্রত্যেকটি পণ্যের দাম দুই থেকে পাঁচগুণ বাড়তি দেখানো হয়েছে।
গবেষণার জন্য ব্যয় হবে ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ইনোভেশন খাতে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র ৩০টা অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির ব্যয় দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮০টি সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ করা হবে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। পাঁচটি ডাটাবেস তৈরিতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য ব্যয় হবে আরও ৪৫ কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।
দাতা সংস্থার ঋণে দুটি প্রকল্পে পণ্যসামগ্রীর সম্ভাব্য অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করেনি। আমার পক্ষে ওই প্রকল্প তৈরিতে সময় দেওয়াও সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয় ও আমাদের প্লানিং শাখা থেকে করা হয়েছে। তবে আমি বলে দিয়েছি, বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির মাধ্যমে যেন ক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়। অতিরিক্ত কোনো মূল্য ধরা হলে তা যেন যাচাই-বাছাই করা হয়। সূত্র: সমকাল।