বাংলা একটা কবিতার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।।’ হুজুগে মানুষের গুজব আর হা-হুতাশ শুনতে শুনতে বারবার শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি মনে আসছে। বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় কবি খুব ভালো করে নিজ দেশের মানুষকে চিনেছিলেন বলেই হয়ত এমন কবিতা লিখতে পেরেছিলেন।
বর্তমান সময়ে সবচাইতে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রল হচ্ছে, করোনা ভাইরাসে মারা গেছে যত, তার থেকে বেশি পাওয়া যাচ্ছে চোর। বিষয়টিকে আরো বাড়িয়ে গড়ে বলে যাচ্ছি আমরা, ‘সকল জনপ্রতিনিধি চোর’। বাংলাদেশে করোনার চিত্র হলো, এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৫০জন। আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩১। সুস্থ হয়েছেন ৪৯জন। আর এদিকে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে চোর ধরা পড়েছে ১৪ জন। তারও অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও মেম্বার।
এবার দেখি বাংলাদেশে মোট জনপ্রতিনিধি কতজন। জনপ্রতিনিধির সংখ্যাটা হচ্ছে মেম্বার ৪১১৩৯ জন, মহিলা মেম্বার ১৩৭১৩ জন, ইউপি চেয়ারম্যান ৪৫৭১ জন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ/মহিলা- ৯৮৪ জন, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯২ জন, পৌর মেয়র ৩৩০ জন, সংসদ সদস্য ৩৫০ জন। অর্থাৎ বাংলাদেশে মোট জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৬১৫৭৯ জন। এবার শতকরায় হিসেবে আসি। মোট জনপ্রতিনিধির ০.০৩ শতাংশ। এর থেকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা আর চোর, ডাকাত ও দুর্নীতিবাজদের অনুপাত বের করলে ঢের বেশি পাওয়া যাবে। অবশ্য এই ০.০৩ শতাংশ বলে যে তারা মাফ পেয়ে যাবেন বিষয়টা এমন নয়। বরং এই ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন চেয়ারম্যান এবং ৫জন মেম্বারকে বরখাস্ত ও দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়েছে আরো ২ জনকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে এদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে। আর অনেকেই হয়ত ভুলে যাচ্ছেন, এই চোরদের ধরা হচ্ছে এবং তাদের মুখোশ উন্মোচন করছে বর্তমান সরকারের অধীনে থাকা প্রশাসন।
এবার আসি চালের খোঁজে। এগুলো করোনার লকডাউন উপলক্ষে দেয়া সরকারি ত্রাণের চাল নয়। এখন পর্যন্ত দেশে যতস্থানে চুরির চাল পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ বয়স্কদের, বিধবাদের বা ১০টাকা দরে বিশেষ মূল্যে বিক্রি করা চালের। আর তা চুরি হয়েছে কিভাবে? ঐ যে বললাম, আমরা প্রত্যেকে অতি সৎ। আর সে কারণেই নিজের নাম একবার লিস্টে উঠানোর জন্য যেমন সচেষ্ট থাকি, একইভাবে হাতে যেই সেই চাল এসে পৌঁছায় বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লাগি। এই চালগুলো যাদের নামে ছিলো তাদের প্রত্যেকের হাতে সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে চাল তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সেটি নিয়ে আবারো বিক্রি করে দিচ্ছে অল্প কিছুদূরে গিয়ে। ধরা পড়া অধিকাংশ চালের পেছনের হিসেব এটি।
আসলে ক্ষমতাসীন দলের কতগুলো মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাহিরে বের হচ্ছে মানুষকে সহায়তার জন্য সমালোচনার সময় সেই হিসেব কী আমরা রাখি? আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশটা গরিব, একটা ছোট এলাকায় ৫০০ মানুষের ত্রাণ দরকার। এক্ষেত্রে হয়তো ত্রাণ সরবরাহ করা গেছে ২০০ জনকে। এ কারণে কিছু সমালোচনাও হচ্ছে। খালি পেটে করা সেই সমালোচনা ও গালি মুখ পেতে নিলাম। কিন্তু যারা নিজের ঘরে আরাম করে বসে বসে জমিয়ে রাখা খাবার খাচ্ছেন আর বলছেন, ‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ তার সেই কথা বলা আগে নিজের অবস্থানের কথা জানা উচিত। গাল ভরা সমালোচনা করতে করতে আমরা সবাই যদি নন্দলাল বনে যাই, তবে হতভাগা দেশের অবস্থা কী হবে?
১৯৭৪/৭৫ সালেও এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নাজেহাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। রাতারাতি বাসন্তিকে জাল পরিয়ে লজ্জা নিবারণে কথা বলা হয়েছে খাদ্যের জন্য ভুখা মিছিলও করানো হয়েছে। তাদের প্রেতাত্মারা আবারও ঘোলাজলে মাছ শিকারে তৎপর। যেসব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐসব বর্ণচোরাদের সমর্থন দিচ্ছেন তারা ও সতর্ক হোন। এই শ্রেণী ঢালাও ভাবে বলছে, ‘ওদের বাপ দাদারা কম্বল চুরি করেছে তাদের সন্তানরা ত্রাণ চুরি করছে।’ যারা কথাগুলো বলছেন এবং যারা তার পাশে কমেন্টে ‘সহমত’ লিখছেন, তারা কতটুকু সহায়তা করছেন নিজ প্রতিবেশী বা আত্মীয়কে। আপনার বাসার কাজের বুয়া এখন কি করছেন, কিভাবে জীবনযাপন করছেন সেই খোঁজ কী আপনার আছে? একবারও কী ভেবে দেখেছন আপনার এমন উক্তি ভালো কাজ করে যাওয়া মানুষগুলোকেও আঘাত করছে?
কোন চোরের পক্ষে কথা বলার জন্য আসিনি, সত্যি কথাগুলো বললাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অন্যায়কে সহ্য করে না। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এর থেকেও বড় ও শক্তিশালী নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। ইনশাল্লাহ আমরা এই মহামারী কাটিয়ে উঠবো, আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
সর্বশেষে বলবো, চোরদের ধরিয়ে দিন। নিজের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। সমালোচনাটা হোক গঠনমূলক। মানুষের বিপদে দাড়াতে কোন দল লাগে না। লাগে শুধু এইটি মহৎ হৃদয়। যেটি প্রমাণের উপযুক্ত সময় এটি।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা।