বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য বাংলা নববর্ষ। সাত শতকে রাজা সশাংক এর প্রচলন শুরু করেন। পরবর্তিতে মুঘল সম্রাট বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। মুঘল সম্রাটের জ্যোতিষী ফাতেহ উলাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মান করেন। ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গননা শুরু হয়। প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। বাদশাহ আকবরের সময়ে চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল খাজনা, মাশুল বা শুল্ক পরিশোধের জন্য। বৈশাখের প্রথম দিনটিতে হাল খাতা অর্থাত, পুরানো হিসাব ফেলে দিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খোলা হত। বাংলার মুঘল সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম এর প্রচলন শুরু করেন।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বঙ্গে এবং শ্রীলঙ্কায় এই উৎসব পালিত হয়। ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরও একই দিনে গুরু নানকের জন্মদিন পালন করে ।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম উৎসবটি ছিল আসলে মেলা। গ্রামের প্রত্যান্তাঞ্চলে বৈশাখ মাস জুড়েই মেলার আয়োজন হত। সকাল থেকেই একজন ঢুলি ঢোল বাজিয়ে জানান দিত আজ এখানে মেলা বসবে। দুপুরের আগেই কলা পাতার ছাউনি গড়ে দোকান বসত দেশজ পন্যের আর ফলের। পাওয়া যেত বাংগি, তরমুছ, সহ ফলমুল। তাতি, কুমার,কামারের পশরা বসত মেলায়।ছুরি, চাকু নিয়ে বসত কামার আর বেদেরা চুড়ির আলতা স্নোর ঝুড়ি নিয়ে। বরকি বাশি আর বাকা ছুরি কিনতে ছেলেরা ভিড় করত, তরুনীরা জড়ো হত বেদেদের চুড়ি আলতার দোকানে। খই মিষ্টি নিয়ে আসত গোয়ালরা। দুই পয়সার মাটির পাতিল কিনতে ভিড় জমত কুমারের দোকানেও। টিনের বাক্সে বাইস্কোপ দেখতে বায়না ধরত ছেলে মেয়েরা। বানর নাচ আর চরকি চড়ার আনন্দই ছিল ভিন্ন রকম। আরও একটি খেলা হত, ঘুড়ি উড়ানো। কাটাকাটি খেলাহত আকাশে। লাটাই হাতে যূবকদের দৃষ্টি ছিল উর্ধমূখি। আকাশে কেটা পরা ঘুড়ির হেলেদুলে চলার সাথে ছেলেরাও দৌড়ে যেত ঘুড়ির সাথে। বড়রাও সন্ধায় মাটির হাড়িতে খই মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, পরিবারের সাথে মিলিত হতেন আনন্দে।
এখন সেই অবস্থাটির পরিবর্তন হয়েছে। এখন কেউ আর মাটির তৈরি বরকি বাশি বাজিয়ে আনন্দ করেনা। এখন হয় মংগল শোভাযাত্রা। ফানুষ আর বিচিত্র মুখোশ পরে লক্ষ মানূষ মিছিল করে হস্ত তৈরি হাতী ঘোড়া আর হরিনের পিছে। মুখে আল্পনা একে মোড়ে মোড়ে ইলিশ পান্তা খেয়ে স্বাগত জানায় বাংলা বর্ষকে। হালখাতার চিত্রটিও এখন আধুনিক। প্রচলনটি রেখেই আধুনিক সংস্ক্ররন হয়েছে ঐতিহ্যের। বলাচলে নববর্ষ এখন বাঙ্গালীর অন্যতম প্রানের উৎসব।
এবার ব্যহত হবে উৎসবটি। করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্থ বিশ্ব এখন। জীবন বাঁচাতে সকলেই গৃহে বন্দি সবখানে। রমনা বটমুলে ঐতিহ্যের বর্ষবরন হবেনা, হবেনা মংগল শোভাযাত্রাটিও। তবুও বাংগালীর অবচেতন মন গুঞ্জরিত হবে ” এসো হে বৈশাখ, এসো এসো… “। এই গুঞ্জনেই দুঃখ মূছে পৃথিবীর সব জড়া নির্মুল হওয়ার প্রার্থনা ধ্বনিত হবে প্রত্যাশাই করি। আসুন সবাই মিলে বর্ষ বরন করি, সকলে মিলে প্রার্থনা করি বাংলা আবার মুখরিত হবে , ফিরে পাবো বৈশাখ আবার আপন মহিমায়।
আজিজুর রহমান প্রিন্স
রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক
টরেন্টো, কানাডা
১৪ এপ্রিল ২০২০