প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
৫ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ,
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন। উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও শান্তশিষ্ট। ঘরে স্ত্রী, দুই কন্যা। খুব সুন্দর চলছিল সংসার। ছোট মেয়েদের নিয়ে হাসি – ঠাট্টায় জমিয়ে রাখতো পরিবারকে।
এ ভাবে বেশ কয়েকবছর কাটলো। মেয়েরা বড় হলো। বড় বাসা ভাড়া নিতে হলো। চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আগের মতো আর হাসিখুশি নেই হারুন। সংসারের চাহিদার তুলনায় বেতন অল্প। ফলে প্রতিমাসেই টিউশনি।
এরই মধ্যে গ্রামের ছোট ভাই যে একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তাকে লেখাপড়ার খরচ পাঠানো। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এক কথায় নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ব্যয়ভার চালানো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অল্প অল্প ঋণ করতে করতে বর্তমানে ঋণের স্তূপের নিচে পড়ে খাবি খাচ্ছে সে।
পাঠকগণ, উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র, হাসিখুশি সেই হারুন এখন অতীত। বাসায় ফিরলে কেউ কিছু দাবী করলেই জ্বলন্ত বারুদের মতো জ্বলে উঠে সে, রীতিমতো আগুন হয়ে যায়। কারণ, একটাই ঋণে খাবি খাওয়া হারুন এখন উন্মাদ পায়। আশেপাশের সবাই তাকে শান্তনা দেয়, উপদেশ দেয়, উৎসাহ দেয়।
কিন্তু, ঋণের জ্বালা যার সেই বুঝে তার কষ্ট। সুদখোর মহাজনদের নিকট থেকে আনা টাকা দিনদিন চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়তে থাকে। দ্বারস্থ হয় বেসরকারি এনজিওর। অল্প টাকা এনে সুদ পরিশোধ করলেও মূল থেকে যায়। আবার ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সে। আবারও কিছু টাকা এনে কিছুঋণ পরিশোধ করলেও এখন তার ব্যাংক, এনজিওর কিস্তি ও অন্যান্যচাপ বৃদ্ধি পায়।
যে হারুন কখনও মিথ্যা বলতনা সে হারুনই দিনরাত মিথ্যাটাকে নিয়মিত রুটিন করেছে, ঘরে বাইরে সব জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এক সময়ের সাড়া জাগানো সেরা ও জনপ্রিয় শিক্ষকটি আজ শুধু নামে আছে, কাজে নেই।
আজ বাড়িতে আরও চটেছে হারুন। তার বড় মেয়েটা হটাৎ তাকে বলে ওঠে, “বাবা, তুমি না বাড়িতে ঘর করবা বলছিলা? ” শুনেই ক্ষেপে ওঠে সে। বলে ওঠে, “চুপ কর। আমাকে তোরা ঘরে আসতে দিবিনা? ” বলেই অন্য ঘরে চলে আসে সে।
মেয়টি যে কাঁদছে তা শুনতে পায় আর নিরবে সেও কাঁদে। তার কান্না কেউ দেখেনা, কেউ শুনেনা। মনে মনে ভাবে কারও জন্য কিছুই করে যেতে পারবোনা। অথচ আমি জাতির বিবেক। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি। আমি মানুষ গড়ার কারিগর। আমি সম্মানজনক পেশায় আছি, কিন্তু অসম্মানজনক বেতন পাই। তার খুব মনে পড়ে, গত বছর বলেছিল, শীতকালে গ্রামের বাড়িতে একটা ঘর করবে সে।
লজ্জায় আজ সে কাউকে মুখ দেখাতে পারছেনা। মেয়ের দিকে তাকাতে পারছেনা। কি করবে ভাবতেও পারছেনা। মেয়েগুলোকে ভালো একটা স্কুলে দিতে পারছেনা।
এদিকে হারুনের স্ত্রীর সন্দেহের তীর তার দিকে। তার চিন্তা তার স্বামী তাকে আর পছন্দ করেনা, হয়তো সে নষ্ট হয়ে গেছে। স্ত্রীকে সব বলতে পারছেনা। তার স্ত্রী অত্যন্ত সরলসোজা মহিলা, একটু বেশি ধর্মভীরু।
অসহায় হারুন এখন একা। সবাই থাকতেও নিঃসঙ্গ। ভাইবোন আত্মীয়-স্বজন সবাই তার থেকে দূরে সরে গেছে। তাকে কেউ আর ভালবাসেনা।
সুপ্রিয় পাঠকগণ, এই যদি হয় একজন বেসরকারি শিক্ষকের জীবন কিভাবে সে সমাজকে কিছু দিবে। কিভাবে সে আদর্শ নাগরিক গড়ে তুলবে।
আসুন হারুনদের মতো শিক্ষকদের বাঁচাতে তাদের জাতীয়করণ, বদলি ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার কথা বলি।
( হারুন কথাটি কাল্পনিক কিন্তু গল্পটা বর্তমানে অনেক মাধ্যমিক শিক্ষকের ক্ষেত্রে বাস্তব)
প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।