ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারানো দক্ষিণ ভারতের মহীশুরের রাজা টিপু সুলতান সম্পর্কে যা যা লেখা আছে কর্নাটকের স্কুলে ইতিহাসের পাঠ্যবইগুলোতে, তা সরিয়ে দেয়ার কথা ভাবছে সে রাজ্যের সরকার। বর্তমানে কর্নাটকে বিজেপির সরকার ক্ষমতাসীন। খবর বিবিসি বাংলার।মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা জানিয়েছেন, টিপু জন্মজয়ন্তী আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুল পাঠ্যবইতে যা রয়েছে টিপু সুলতানের সম্পর্কে, সেগুলোও সরিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমরা। সিদ্ধান্ত নেয়া যে সময়ের অপেক্ষা, সেটাও উল্লেখ করেছেন ইয়েদুরাপ্পা।বিজেপির এক নেতা এর আগে দাবি করেছিলেন যে টিপু সুলতানকে যেভাবে গৌরবান্বিত করা হয় স্কুলের পাঠ্যবইগুলোতে, তা বন্ধ করা উচিত। টিপু সুলতান হিন্দুদের ওপরে সাংঘাতিক অত্যাচার করতেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন কোডাগু জেলা থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য বিজেপির এ. রঞ্জন।টিপু সুলতানের ওপরে বহুদিন ধরে গবেষণা করেছেন মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান যোসেফ। তিনি বলেন, টিপু সুলতানকে ভারতীয় ইতিহাসের একজন ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।বর্তমানে ‘নলওয়াঢি কৃষ্ণারাজা ওয়াদিয়ার চেয়ার’-এর ভিজিটিং প্রফেসর যোসেফ বলেন, টিপু সুলতানকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সেগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। টিপু সুলতানকে একজন খলনায়ক করে তোলার এই প্রচেষ্টাটা কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে।এই প্রথম নয়, এর আগে কর্নাটকে সরকারিভাবে পালিত টিপুজয়ন্তী বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিজেপির আমলে।বিজেপি এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মনে করে টিপু সুলতান কুর্গ, মালাবারসহ নানা এলাকায় কয়েক লক্ষ্য হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন।আরএসএসের মতাদর্শে বিশ্বাস করে, এমন একটি সংগঠন, ইতিহাস সংকলন সমিতির পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ইতিহাসের অধ্যাপক রবিরঞ্জন সেন বলছিলেন- তার মতে, বাস্তবে যা যা করেছেন টিপু সুলতান- সবটাই থাকা উচিত।তিনি বলেন, তিনি (টিপু সুলতান) যেমন ধর্মীয় নিপীড়ন চালিয়েছেন তেমনই বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণও করিয়েছেন। এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। অধ্যাপক রবিরঞ্জন বলেন, আমাদের মতে তার যদি কিছু অবদান থেকে থাকে সেগুলোর সঙ্গেই নেতিবাচক দিকগুলোও থাকা দরকার।তার মতে, অনেক সময়েই পাঠ্যপুস্তকে একপেশে, এক ধরনের ইতিহাস লেখা হয়ে এসেছে। কিন্তু তার জীবন আর শাসনামলের দুটি দিকই তুলে ধরা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।তবে টিপু সুলতান যে হিন্দুদের ওপরে নিপীড়ন চালিয়েছিলেন বা লাখ লাখ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন বলে আরএসএস যে দাবি করে, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক যোসেফ।তিনি বলেন, টিপু সুলতানকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এরকম তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না যে তিনি নির্দিষ্টভাবে হিন্দুদের ওপরেই অত্যাচার করেছিলেনঅধ্যাপক যোসেফ বলেন, কুর্গ বা মালাবার উপকূলে যুদ্ধ নিঃসন্দেহে হয়েছিল সেখানকার হিন্দু শাসকদের সঙ্গে এবং সেই যুদ্ধে অনেক হিন্দুর যে প্রাণ গিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না – কিন্তু সেটাকে একটা ধর্মীয় অত্যাচার বলা ভুল।তিনি বলেন, মহাভারতের কাহিনীতে তো যারা নিহত হয়েছিলেন, তারাও হিন্দুই ছিলেন। আবার মারাঠারা যখন মহীশুর দখল করতে এসেছিল, তখন তারা অতি পবিত্র হিন্দু তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠ ধ্বংস করে দিয়েছিল- এমনকি বিগ্রহটিও ধ্বংস করে দেয় তারা।শৃঙ্গেরি মঠ পুনর্নির্মাণে অর্থ দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। এগুলোকে তো ধর্মীয় নিপীড়ন বলা যায় না, ব্যাখ্যা করছিলেন অধ্যাপক যোসেফ।টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতেন, রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে শাসন চালাতেন একজন হিন্দু- পুন্নাইয়া। আবার মালাবার দখল করার সময়েও টিপুর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রাও- তিনিও হিন্দু।অধ্যাপক যোসেফের যুক্তি, টিপুর পরেই যার হাতে সব ক্ষমতা, সেই পুন্নাইয়া, কুর্গে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার করতে দিয়েছেন, এটা কি যুক্তিগ্রাহ্য বা হিন্দু হয়েও শ্রীনিবাস রাও মালাবারে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ করানোতে মদদ দিয়েছিলেন- সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?টিপু সুলতান ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার ১২ ছেলে এবং পরিবার-পরিজন সবাইকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার।সেই থেকে কলকাতাতেই টিপুর পরিবারের বসবাস। শহরের সবচেয়ে পরিচিত মসজিদ ‘টিপু সুলতান মসজিদ’ রয়েছে কলকাতাতেই, তেমনই তার পুত্র আনোয়ার শাহ এবং পরিবারের আরও কয়েকজনের নামে রয়েছে শহরের বড় বড় কয়েকটি রাস্তার নাম।