আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানে বেশ কয়েকজন ক্যাসিনো ‘সম্রাট’ ধরা পড়লেও অনলাইনে এখনও পুরোদমে চলছে এ জুয়া খেলা। এই খেলা বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) শতাধিক জুয়ার সাইট বন্ধ করলেও ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে এ বেআইনি কাজ করে যাচ্ছেন জুয়াড়িরা। তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগে বন্ধ করা সম্ভব অনলাইন ক্যাসিনো। র্যাব এখনও রাঘব-বোয়ালদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করতে রাজি হয়নি।
যেসব স্পোর্টিং ক্লাবের অন্তরালে ক্যাসিনো ব্যবসা চলত সেসব জায়গায় অভিযানের পর ক্যাসিনোর আসর ‘নিয়ন্ত্রণে’ আসলেও অনলাইন ক্যাসিনোর ‘মূলহোতা’ সেলিম প্রধানকে আটকের পরও অনলাইন ক্যাসিনো চলছে অনেকটা আগের মতোই। এছাড়া ক্যাসিনো বন্ধে চলতি বছরের শুরুর দিকে বিটিআরসি যে উদ্যোগ নিয়ে ১৭৬টি জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল তা তেমন কাজে আসেনি। কারণ ভিপিএন ব্যবহার করে জুয়াড়িরা খুব সহজেই ওইসব ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইনে বাংলাদেশিরা ক্যাসিনো খেলায় যুক্ত হন মূলত তিনটি উপায়ে। প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাসিনো ওয়েবসাইটগুলোর বিজ্ঞাপন, পরিচিত বন্ধু-বান্ধব (যারা ইতোমধ্যে ক্যাসিনোয় জড়িত) ও অনলাইন ক্যাসিনো চালানোর জন্য বাংলাদেশে দালাল হিসেবে পরিচিতদের মাধ্যমে। তবে কেউ ক্যাসিনো খেলবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেই খেলায় যুক্ত হতে পারেন না। কারণ টাকা পরিশোধের তেমন কোনো বৈধ পন্থা নেই। তাই প্রথমে তাকে ভিপিএন ব্যবহার করে ওয়েবসাইট সিলেক্ট করতে হয়, এরপর বের করতে হয় পেমেন্ট গেটওয়ে। অনলাইন পেমেন্ট বাংলাদেশ থেকে কিছুটা কঠিন হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইচ্ছুককে বাংলাদেশি কোনো একজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে নির্ধারিত কিছু ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করার পর একটি মোবাইল ব্যাংকিং নাম্বার কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেয়া হয় এবং ওই নাম্বারে টাকা পাঠানোর পর তার ক্যাসিনো অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। তবে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা যেকোনো লেনদেনের মাধ্যমে চিপস কিংবা ডলার কিনতে হলে দালালদের শতকরা ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি টাকা দিতে হয়। এরপর খেলা শুরু করলে যেমন টাকা যোগ হয়, তেমনি হেরে গেলে কেটে নেয়া হয় টাকা।
অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা মূলত নেটেলার ব্যবহার করতেন। তবে এক্ষেত্রে ডলার কিনতে হলেও বেশিরভাগকেই কোনো না কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কারণ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি রয়েছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড ও ওয়্যার ট্রান্সফার ব্যবহার করেও লেনদেন করেন জুয়াড়িরা।
বাংলাদেশের অনলাইন জুয়াড়িদের পরিচিত ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে, বেট থ্রিসিক্সটি ফাইভ, বেট এশিয়া, ডাবলটু বেট, ত্রিপল এইট ক্যাসিনো, রয়্যাল ভেগাস ক্যাসিনো, জ্যাকপট সিটি ক্যাসিনো, ইইউ ক্যাসিনো, সান প্যালেস ক্যাসিনো, ভোগাস ক্যাসিনো, বেট উইনার, ওয়ানএক্স বেট। এসব ওয়েবসাইটে কীভাবে জুয়া খেলতে হয় এবং কীভাবে পেমেন্ট করতে হয় সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পেজ ও দেশে কিছু ওয়েবসাইটও গড়ে উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পেমেন্টেও সহায়তাও পাওয়া যায় ওইসব পেজ ও ওয়েবসাইটগুলো থেকে। এছাড়া ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি ম্যাচ চলাকালে লাইভ বাজি ধরার সব ধরনের উপায়ই বাতলে দেয় এসব পেজ ও ওয়েবসাইটগুলো।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় দালাল ছাড়া কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে লেনদেন করে থাকেন তবে তাদেরও ধীরে ধীরে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
অনলাইন ক্যাসিনোর ক্ষেত্রে যেহেতু ওয়েবসাইটে ঢোকা বাধ্যতামূলক তাই এ বিষয়ে পদক্ষেপের কথা জানাতে গিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সময়নিউজকে বলেন, দেশের জুয়াড়িরা যেসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্যাসিনো খেলতেন সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকেই এ রকম ১৭৬টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। এর বাইরে অন্যকোনো ওয়েবসাইটের খোঁজ মিললে তাও বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ভিপিএন ব্যবহার করে ব্যক্তির অবস্থান অন্যস্থানে দেখিয়ে নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে লগইন করা সম্ভব। তবে সব ভিপিএনই নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকরও নয়। ভিপিএন শুধু খারাপ কাজেই ব্যবহার হয় না, তাই কিছু ভিপিএনের অনুমোদনও রয়েছে। কেউ যদি ভিপিএন ব্যবহার করে খারাপ কাজে যুক্ত হন এবং সেই খোঁজ আমাদের কাছে আসে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সালাহউদ্দিন সেলিম সময়নিউজকে বলেন, অনলাইন ক্যাসিনো খেলুড়েরা এখন মূলত ভিপিএন ব্যবহার করে ওয়েবসাইটগুলোতে লগইন করছেন। ভিপিএনের মাধ্যমেই তারা এ কাজ করে যাচ্ছেন। তবে ভিপিএনের মাধ্যমে শুধু খারাপ কাজই হয় না। তাই আমাদের উচিত ভিপিএনের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে যারা এটি ব্যবহার করে এই অন্যায় কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
ভিপিএন বন্ধ না করেও কীভাবে জুয়াড়িদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশিরভাগ অনলাইন ক্যাসিনো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয় এবং সেখানে টাকা লেনদেন হয়। এখন অনেকেই ওয়্যার ট্রান্সফার ব্যবহার করে এই লেনদেন করেন। ওয়্যার লেনদেনে যেহেতু সুইফট কোড ব্যবহার করে লেনদেন করতে হয়। তাই টাকাটা কোন উৎস থেকে ব্যক্তির কাছে আসলো কিংবা ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা কোন উৎস গেল তা বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে এই উৎস বের করে অনলাইন জুয়াড়িদের আইনের আওতায় আনতে পারে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সময়নিউজকে বলেন, ক্যাসিনো বিষয়টি নিয়ে আমি এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।