আব্দুল আলীম, চৌগাছা প্রতিনিধিঃ শিক্ষা জীবনে প্রাথমিকে বয়স যখন ৫ থেকে ১০ বছর তখন শিশুদের থাকে বাধাহীন জীবন। কিন্তু মাধ্যমিকেও বয়স যখন ১১ থেকে ১৬ বছর। তখনও তো বাধাহীন জীবন, জীবনকে না বোঝার সময়, উচ্ছাসের সময়, স্কুল পালানোর সময়। কিন্তু কাব্যিক কথায় পৃথিবী চলে না। বিদ্যালয় পালানো শিক্ষার্থী দিয়েতো আর দেশ গঠন সম্ভব নয়। এজন্য বিদ্যালয়ের প্রায় শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার জন্য মিডডে মিল অন্যতম হাতিয়ার।
গবেষণার দরকার নেই স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় বিদ্যালয়ে অবস্থানকালের একটি লম্বা সময় শিক্ষার্থীদের অভূক্ত থাকতে হয়। এই সময় তারা ভাজা জাতীয় খাবার এবং ফাস্ট ফুড অর্থাৎ সিঙাড়া, পুরি, আলুর চপ, সমচা, ছুলা, ভাজা, মুড়ি ইত্যাদি খেয়ে থাকে। যা তাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই জন্য প্রয়োজন মিডডে মিল। এটি শিশুর শরীরের বিকাশ, মেধার বিকাশের জন্য জরুরী। একটি লম্বা সময় যদি শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন অভূক্ত থাকে তাহলে সে শিক্ষার্থী দিয়ে লম্বা সময়ের জন্য বিদ্যালয়ের প্রত্যাশা খুব বেশি নয়। নিদির্ষ্ট সময় পর স্কুল বিরতিতে আহার গ্রহণই হচ্ছে মিডডে মিল। এজন্য দরকার টিফিন বক্স আর নিয়মিত খাবার নিয়ে আসা। দেশের অনেক উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে টিফিন বক্স প্রদান করা হয়েছে এবং এগুলোতে প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসতে শিক্ষকদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিক্ষগণ সেই নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের উপর প্রয়োগ করে বাড়ি থেকে টিফিন বক্সে খাবার নিয়ে আসা নিশ্চিত করছে। এতে করে সক্ষম ব্যক্তিদের ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসছে। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্কুলের পক্ষ থেকে সমাজের বিত্তবানদের পক্ষ থেকে কিংবা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত বিষয়টি হচ্ছে চর্চার এবং সচেতনতার। প্রতিটি অভিবাবককে অবশ্যই তার সন্তানদের খাদ্যের বিষয়ে সচেতন এবং সতর্ক হতে হবে। দুপুরের খাবারটি যেহেতু এ বয়স বাচ্চাদের শরীর গঠনের জন্য জরুরী। সে জন্য দামী খাবার নয় বরং পুষ্টিকর খাবারই হতে পারে তাদের জন্য নিয়ামক। ভাত, শাক কিংবা ডাল, ডিম এগুলোই যথেষ্ট। আর না হলে সবজি খিচুড়ি খাবার । দুপুরের খাবার গ্রহনের পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় স্কুলের পাঠসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে মনোযোগী হয়ে উঠে। এর ফলে বিদ্যালয় পালানোর প্রবনতা কমছে এবং একই সাথে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একইভাবে মাধ্যমিকেও মিডডে মিল চালুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং তার কার্যকারিতাও দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে।
উদাহরণ স্বরুপ উপর থেকে নির্দেশনা আসার পরে যশোরের চৌগাছা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে উপজেলার প্রত্যেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষকদের মিডডে মিল সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতন করা হয়। মিড ডে মিল মূলতপক্ষে বিদ্যালয়ের উপস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রায় প্রতিটি অভিবাবক/ শিক্ষকই বর্তমান সময়ে মিডডে মিলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক সেকশানে মিডডে মিল চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি প্রাথমিকের সাথে সাথে মাধ্যমিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
চৌগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায় উপজেলার পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত মিডডে মিল চালু আছে। বিদ্যালয়গুলো হলো চৌগাছা সরকারি শাহাদাৎ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ধূলিয়ানী, সিংহঝুলী মশিয়ূর নগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাড়ুয়া ইউসুফ খান স্কুল এন্ড কলেজ এবং পাতিবিলা হাজী শাহাজান আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এছাড়া অন্যান্য অনেক বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষকের স্ব উদ্যোগে মাঝে মাঝে মিডডে মিল প্রদান করে এর ধারাবাহিকতা চালু রেখেছে।
অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, প্রথম দিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে রান্না করে মিডডে মিল চালু করার কথা বললেও বর্তমানে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রান্নার ব্যবস্থা করতে হলে অর্থের একটা ব্যাপার আছে। সরকারি অনুদান ব্যাতিত কতদিন বিদ্যালয়ের খরচে মিডডে মিল চালু রাখা সম্ভব? এই সময় বাধ্য হয়ে বিদ্যালয় কতৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দৈনিক চাঁদার সিস্টেম করবে। এতে শিক্ষকগণকে অভিভাবকদের চাপের মুখে থাকতে হবে। এই কথা বিবেচনা করে বলা হয়েছে সকল শিক্ষার্থীকে (মায়ের হাতে রান্না) দুপুরের টিফিন নিশ্চিত করতে হবে। টিফিনের সময় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধায়নে শিক্ষার্থীদের আনা টিফিন সকল শিক্ষার্থী একত্রে বসে খাবে। এটায় হবে মিডডে মিল। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষক নিশ্চিত করবে সকল শিক্ষার্থী মিডডে মিল হিসাবে দুপুরের টিফিন (মায়ের হাতে রান্না) আনছে কিনা। যদি কোনো শিক্ষার্থী এটি আনতে ব্যার্থ হয় তবে অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করে তাকে এবিষয়ে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা চালাতে হবে। এতে করে শিক্ষার্থীদের লম্বা সময় অভূক্ত থাকা লাগবে না। শিক্ষার্থীদের শরীরের সাথে মনও ভালো থাকবে। অনিহা জাগবে না আর লেখাপড়ায়। এতে প্রতি উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে। দেশে শতকরা শিক্ষিতের হার বেড়ে যাবে।বর্তমান নিয়মে সমাজের প্রত্যেকটি বিদ্যালয়েই এই মিডডে মিল চালু সম্ভব।
এ বিষয়ে উপজেলার সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এম মহব্বত আলী বলেন, মিডডে মিল একটা ভালো ব্যবস্থা এবং শিশুদের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমার শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এটায় বলতে পারি যে প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রায় সকল মেয়ে শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে সকালে না খেয়ে বিদ্যালয়ে আসে। এমতাবস্থায় তাদেরকে বিকাল পর্যন্ত লম্বা সময় অভূক্ত থাকতে হয়। যেখানে বিজ্ঞান বলে সকালে ক্ষেতে হবে সবচেয়ে বেশি, দূপুরে তার চেয়ে কম এবং রাত্রে সবচেয়ে কম। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে জরিপ চালালে দেখা মিলবে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ছাত্রী এবং ৫০ ভাগ ছাত্র সকালে না খেয়ে বিদ্যালয়ে আসে এবং বাড়িতে ফেরত যায় বিকালে। এর মাঝে তারা খালি পেটে ফাস্ট ফুড খেয়ে বিদ্যালয়ের লম্বা সময়টি পার করে থাকে। যা বাংলাদেশের মত দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য শারীরিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিক্ষার্থীদের এহেন দূঃসময়ে মিডডে মিল নামক ব্যবস্থা চালু করণের জন্য আমি ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানায়। আমার বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় মিডডে মিল চালু করতে সক্ষম হয়েছি। চেষ্টা করবো তা অব্যাহত রাখার। নিশ্চিত করবো কোনো শিক্ষার্থী এই মিডডে মিলের আওতাবহির্ভূত চলছে কিনা। নিশ্চিত করবো বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীকে এর আওতায় নিয়ে আসার। প্রথম প্রথম আমাদের মত কৃষি প্রধান দেশে মাধ্যমিকের শতভাগ শিক্ষার্থীদের মাঝে মিডডে মিল নিশ্চিত করতে একটু কষ্ট হলেও শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় এটি ঠিক হয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদি।