মোঃ খোরশেদ আলম(মুরাদনগর প্রতিনিধি)ঃ
আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন বয়সে তখন যুবক, সুনামের সহিত ব্যবসা করেন। কিন্তু এক ধরনের দু:খ বোধ বিদীর্ন করে তাঁকে। তিনি দেখেন এলাকায় তার বেশির ভাগ সমবয়সীই বেকার। কারন লেখাপড়া শেখা হয়নি তাঁদের। এর কারন আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও অভাব। আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন ঠিক করলেন, তিনি নিজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়বেন। ওই বয়সেই তিনি কুমিল্লার মুরাদনগরের কুড়ের পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেন মুরাদনগরের প্রথম মহিলা কলেজ। এটা ১৯৯৬ সালের কথা। সেই থেকে আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন একের পর এক স্কুল কলেজ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ১৬ টি। এর মধ্যে স্কুল ৯টি, কলেজ দু’টি, ও মাদ্রাসা পাঁচটি। এগুলো ছড়িয়ে আছে কুমিল্লার মুরাদনগর ও বিভিন্ন উপজেলা সহ আশপাশের এলাকায়। আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের বয়স এখন ৭৩ বছর। এই বয়সেও শিক্ষার জন্য ত্যাগে তিনি নিরলস, নিঃস্বার্থ। তিনি দরিদ্র মেধারী শিক্ষার্থীদের ভরসা। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, যে কোন বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। খবরের কাগজের অসহায় মানুষের খবর পড়েই তিনি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে ছুটে যান। রাজনৈতিক ক্ষমতা জনসেবার সহায়ক হয়-এ ধারণা থেকে তিনি অনেক বছর রাজনীতিও করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল শিক্ষা ও সমাজ সেবার দিকে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সমাজ সেবায় উন্নতি ঘটাতে জন প্রতিনিধি হওয়া চাই-এ ধারনা থেকে তিনি এক পর্যায়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দিতা করে হেরে যান আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন জানান, ১৯৭০ সালে তিনি ব্যবসা-বানিজ্য করে আয় রোজগার করেন। সেই টাকা দিয়েই তিনি এখন পর্যন্ত সেবা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর মুরাদনগর উপজেলার ভূবনঘর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক (তখনকার মেট্রিকুলেশন) পরীক্ষায় ১টি বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগ, ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইকম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে, প্রথম স্থান ও ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,কম (অনার্স) পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে অষ্টম স্থান অধিকার করে পাশ করেন। সে বছর থেকে চার্টার্ড একাউনটেন্ট (এফসিএ) পেশা বেছে নেন। পুঁজি খাটিয়ে ছোটখাট ব্যবসা শুরু করেন। সীমিত সামর্থ্য নিয়েই আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন শুরু সহ সমাজ সেবায় মনোনিবেশিত শুরু করেন ওই সময় থেকে। শুরু হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে মুরাদনগরের কুড়ের পাড়ে আদর্শ মহিলা কলেজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। তারপর ১৯৯৯ সালে গোমতা স্কুল এন্ড কলেজ, ২০০০ সালে রহিমপুর হেজাজিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। মুরাদনগরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুড়ের পাড়ের আদর্শ মহিলা কলেজটি জেলার ব্রাক্ষ্ণণ পাড়া, দেবিদ্ধার ও মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান গুলোর একটি- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়েছেন আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। ২০০৩ সালে তিনি মুরাদনগরের খামার গাঁও গ্রামে জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা করেন। এছাড়া উপজেলার কামাল্লা মাদ্রাসা, সোনাকান্দা মাদ্রাসা, নবীয়াবাদ মাদ্রাসা, মুরাদনগর মাদ্রাসা, পীর কাশিমপুর মাদ্রাসা, ভবানীপুর মাদ্রাসা, পরমতলা ইদ্রিসিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, কাজিয়াতল ফয়জুল উলুম ও দক্ষিণ পাড়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা, নোয়াখলা খুরুইল মাদ্রাসা, পাহাড়পুর মাদ্রাসা, খামার গ্রাম মাদ্রাসা, টঙ্গী ফয়দাবাদ মাদ্রাসা ও দৌলতপুর মাদ্রাসা সহ মসজিদ মন্দির ও স্কুল কলেজে তাঁর আর্থিক অনুদান রয়েছে। রামচন্দ্রপুর অধ্যাপক আবদুল মজিদ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ বলেন,আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের মতো কাজ পাগল মানুষ এ যুগে দুর্লভ। রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ মানবেন্দ্রনাথ সরকার শিক্ষা বিস্তারে আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের অবদানকে অনবদ্য বলে মন্তব্য করেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা জুগিয়ে থাকেন আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন।এসএসসি পরীক্ষায় মুরাদনগর উপজেলার অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের দুই শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর ছাপা হয় ভোরের কাগজে। সে খবর পড়ে ছুটে যান তিনি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দশ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা দেন এবং তাদের ভবিষ্যতের পড়া লেখার ব্যায়ভার পূরোটাই বহন করার ঘোষনা দেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে ৩২ ইঞ্চি লম্বা প্রতিবন্ধি রোকসানা সেখানে চা বিক্রি করে পড়াশোনা করছে এ খবর জানতে পেরে তিনি তাকে আট হাজার টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। এছাড়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অনেক শিক্ষার্থীকে তিনি মাসে মাসে আর্থিক সহায়তা দেন। তাছাড়া প্রতি মাসে মুরাদনগরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় মোটা অংকের টাকা করে অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন তিনি। উপজেলার কাজিয়াতলে ঋনের টাকা শোধ করতে না পারায় বিষপানে আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি পরিবারের সব সদস্য। এ রকম একটি খবর তাঁর নজরে আসে। তিনি তাদের বিস্তারিত শুনে পরিবারটির ঋনের ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন এবং দুটি রিস্কা ভ্যান কিনে দেন। উপজেলার দারোরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দিন মুজুর আবদুর রশিদের জটিল অস্রোপাচার হয় কুমিল্লা সিডি প্যাথ হাসপাতালে। মুক্তিযোদ্ধা রশিদের চিকিৎসার সব খরচ বহন করেন ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনসেবার ইচ্ছে থেকেই এক সময় তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ইচ্ছে ছিল নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করার। কিন্তু এলাকার কয়েকজন নেতা তাঁকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৩ মুরাদনগর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। “তখন মুরাদনগর সন্ত্রাসের লীলাভূমি ছিল। ওই সময়ের নির্বাচনের কথা এখনো মনে পড়ে। সেখানে আওয়ামীলীগ প্রার্থী হিসেবে আমি বিপুল ভোট পেয়েও সন্ত্রাসীদের কারনে জয়ী হতে পারিনি। তখন লোকজন আমাকে যে সম্মান জানিয়েছেন, তা আজও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে”। স্মৃতিচারন করেন-আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সেবামূলক কাজও করেছেন আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। ব্যবসা ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বে দুটোতেই সমান দক্ষতার প্রমান রেখেছেন আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। ১৯৯৬-৯৮ এবং ২০০০-২০০১ সালে তিনি দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ড্রাষ্ট্রি (এফবিসিসিআই) এর সভাপতি, সাউথ ইষ্ট ব্যাংক লিঃ এর চেয়ারম্যান, (বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত) ম্যাচিং গ্র্যান্ট ফেসিলিটি এর চেয়ারম্যান, ১৯৯৭-৯৯ সালে সার্ক চেম্বার অব কমার্স অব ইন্ডষ্ট্রি এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলিটেশন সেন্টার, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোং লিঃ, ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ লিঃ ও প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। বোর্ড অব এডভাইজার্স দি একোনমিক টাইমস, গুলশান ক্লাব লিঃ, কুর্মিটোলা গোলফ ক্লাব লিঃ এর সদস্য সহ আরো অনেক সামাজিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। মুরাদনগরে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী হিসেবে অসংখ্যবার সংবর্ধনা পান তিনি। সাবেক এমপি এ মরহুম আল্হাজ্ব হারুন আল রশিদের একমাত্র পুত্র আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন মানব সেবার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী সাবেরা পারবীনের ভুমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরন করেন। তাঁর ২ ছেলে। ছেলেরা সবাই সু শিক্ষিত। ৭৩ বছর বয়সী আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন নিজেকে সম্পূর্ণ কর্মক্ষম বলে দাবী করেন। এখনো চশমা ছাড়াই পড়তে পাড়েন। তিনি এখন ঢাকার গুলশানে থাকেন। ভোরে ফজরের নামায পড়ে হাটতে বের হন। ফিরে এসে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে খুঁজে ফেরেন- কোথায় কার জন্য কি করা যায়। এরপর নিজের পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক ও সেবা কার্যক্রমের খোঁজ খবর নেন। পরবর্তীতে সকল বাধা অতিক্রম করে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন এবং ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে নৌকা প্রতিক নিয়ে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন।আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের দান, অনুদান, সাহায্য-সহযোগীতার পরিমান টাকার অঙ্কে কত হবে, তা তিনি জানাতে চান না। তিনি বলেন, দানের ক্ষেত্রে ডান হাতে দিলে বাঁ হাতেও যেন না জানে।