প্রমত্তা যমুনা নদীর হিংস্র থাবায় ঘর-বাড়িসহ সর্বস্ত হারানো মানুষগুলো যখন মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন ঠিক তখনই কুলহীন খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার মতো কর্মের সন্ধান পান তারা। এই খড়কুটোটি ধরে যমুনা বি-ধৌতে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল শিমুলদাইড়, ছালাভরা ও কুনকুনিয়াসহ প্রায় ৩৫টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ কম্বল ও শিশুদের পোশাক তৈরী করে নতুন জীবন লাভ করছেন।
শীত মৌসুমে চাহিদা বাড়ায় রাত-দিন কম্বল ও শিশুদের পোষাক তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছে কারিগররা। প্রতি বছরই বাড়ছে স্থানীয় এই শিল্পের পরিধি। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে অনেক বেকার যুবকের। তবে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বিক্রি কমে গেছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। লেনদেনের সুবিধার্থে স্থানীয় বাজারে একটি ব্যাংক স্থাপনের দাবি তাদের।
জানা যায়, হত-দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের শীত নিবারণের জন্য প্রায় দুই দশক ধরে তৈরী হচ্ছে কম্বল ও শিশুদের পোষাক। এখানকার শ্রমিকদের হাতে তৈরি কম্বল ও পোষাক দেশের ৬০টি জেলার লাখ লাখ মানুষ শীতে খুঁজে নেয়। উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বাংলা, বিশ্বাস, চায়নাসহ ১৬৬ রকমের কম্বল। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকার মধ্যে কম্বল পাওয়া যাচ্ছে এখানে। বাজারের ৫০ থেকে ৬০টি দোকানে প্রতিদিন কেনাবেচা হচ্ছে কোটি টাকার কম্বল ও শীতের পোষাক। একারনে এই শিল্পের খ্যাতি লাভ করেছে কাজিপুর উপজেলা। এই অর্থ এসব শ্রমিকদের ভাগ্যের চাকাকে নিয়ে যাচ্ছে সফলতার শিখরে।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টেসের পরিত্যক্ত ঝুট কাপড় এনে সেলাই করে তৈরি করা হয় কম্বল ও শিশুদের পোষাক। উপজেলার শিমুলদাইড়, বর্শীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মুসলিমপাড়া, মানিকপটল, গাড়বেড়, রশিকপুর, হরিনাথপুর, ভবানীপুর, মাথাইলচাপড়, রৌহাবাড়ী, পলাশপুর, বিলচতল, লক্ষীপুর, বেলতৈল, চকপাড়া, চালিতাডাঙ্গা, কবিহার হাটশিরাসহ ৩২টি গ্রামে গড়ে উঠেছে কম্বল ও পোষাক তৈরীর কারখানা। এই কাজের সঙ্গে ৪০ হাজার নারী পুরুষ প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। কম দামে ভালো মানের শীতের পোষাক ও কম্বল পাওয়ায় এগুলোর চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। গ্রামের নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে বাড়তি আয়েই সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকাররা ভিড় করছে কম্বল ও শিশুদের পোষাক কিনতে।
কম্বল তৈরির সঙ্গে জড়িত কলেজ শিক্ষার্থী মোনারুল ইসলাম, শামিম শেখ ও হাসান আরিফ বলেন, আমরা লেখাপড়ার পাশাপাশি কম্বল ও শিশুদের পোষাক তৈরীর কাজ করি। এতে পড়াশুনার খরচসহ বাড়তি টাকা বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতে পারি। দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন করছি। আমাদের মতো অনেক শিক্ষার্থীই একাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
কম্বল ব্যবসায়ী আলামিন শেখ বলেন, কম্বল তৈরির কাঁচামাল ঝুট কাপড় ঢাকার মিরপুর, সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী আর চট্টগ্রাম থেকে ক্রয় করতে হয়। এখানে শীতের প্রয়োজনীয় কম্বলের পাশাপাশি শৌখিন ও উপহার দেওয়ার মতো কম্বলও তৈরি হয়। এসব কম্বল ১ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে শীত নিবারণের জন্য ঝুট কাপড়ের কম্বল ১০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়। নতুন কাপড়ের কম্বল ১০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
শিশুদের শীতের জামা কাপড় তৈরির কারিগর আয়েশা খাতুন ও আদুরী খাতুন বলেন, ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ শিখে এলাকায় এসে পোষাক তৈরী ও বিক্রি করছি। বর্তমানে আমাদের দেখায় অনেকেই এখন ব্যবসায়ী হয়েছে। আমরা পরিবারের বোঝা নই, আমরা আয় করি। শিশুদের এসব শীতের পোশাক পাইকারি হিসাবে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি পায়জামা ১০ থেকে ২০ টাকায় এবং জামা ৪৫ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়।
শিমুলদাইড় বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী আয়নাল হক বলেন, পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েদের বিয়ের সময় একটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়। এ মেশিন আর ঝুট কাপড় তাঁর জীবনের চাকা ঘোরাতে সহায়তা করে।
ঝুট ব্যবসায়ী আবু তালেব জানান, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশের ৬০টি জেলাতে এখানকার তৈরি কম্বলের গাড়ি পৌঁছে যায়। শিমুলদাইড় বাজার থেকে দিনে ১৫ থেকে ২০টি বড় ট্রাক দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। বাজারের ৫০ থেকে ৬০টি দোকানে প্রতিদিন কেনাবেচা হচ্ছে কোটি টাকার কম্বল ও শীতের পোষাক।
শিমুলদাইড় বাজার ঝুট কম্বল সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম সোহেল বলেন, এ মৌসুমে ব্যবসায়ীরা প্রায় ৫০ লাখ কম্বল তৈরি করে বিক্রির টার্গেট করেছেন। এতে শতকোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এ পর্যন্ত অর্ধেক কম্বল বিক্রি হয়েছে। বাকি কম্বলগুলো জানুয়ারির মধ্যে বিক্রি হবে। তবে শীতের মাত্রা বাড়লে কম্বল বিক্রি হতে সময় কম লাগবে।
তিনি আরও জানান, কম্বল তৈরির কাজে প্রথমে নারীরা যুক্ত হলেও এখন পুরুষেরাও যুক্ত হয়েছে। এ শিল্পে বর্তমানে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ যুক্ত রয়েছেন। এখানে দৈনিক কেনাবেচা হচ্ছে কোটি টাকার কম্বল ও শীতের পোষাক।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিসের প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, কম্বল শিল্পের প্রসার ঘটাতে স্বল্প সুদে ঋণ ও স্থানীয় বাজারে একটি ব্যাংক স্থাপনের প্রয়োজন। তাহলে পাইকার ও ব্যবসায়ীরা নিরাপদে আর্থিক লেনদেন করতে পারবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার বলেন, যমুনা নদীর ভাঙনে প্রায় নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা কম্বল তৈরির কাজ করে বর্তমানে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কয়েক বছর যাবৎ আমরা দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় চিঠি দিয়ে এখানকার কম্বল কেনার জন্য অনুরোধ করছি। এতে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। কম্বল ব্যবসায়ীদের পাশে আমরা ছিলাম, সব সময় থাকব।
আজ ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | হেমন্তকাল | ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ২:০৩ | সোমবার
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি