মোঃ সদরুল কাদির (শাওন):: বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি মোবাইল সেবার মান বিষয়ক যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, দেশের মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কেউই ঢাকা শহরের বাইরে যথাযথ ফোর-জি ইন্টারনেট সেবা দিতে পারছে না।
সম্প্রতি দেশের বড় চারটি শহরে এক ড্রাইভ টেস্ট চালিয়ে বিটিআরসি দেখতে পেয়েছে, ফোর-জি সেবায় গ্রাহকদের অন্তত সাত এমবিপিএস ডাউনলোড স্পিড পাবার কথা থাকলেও, বাস্তবে কোন কোন জায়গায় ডাউনলোড স্পিড পাওয়া যাচ্ছে এর অর্ধেক।
এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বরিশালে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।বরিশাল সদরে উপজেলা ডিজিটাল সেন্টারের একজন উদ্যোক্তা অনিতা দেবনাথ।এ সেন্টার থেকে প্রতিদিন অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্টের আবেদন, পাসপোর্ট ফি জমা এবং ভিসার আবেদনসহ নানা ধরণের সেবা দেয়া হয়।
এসব সেবার জন্য দরকার দ্রুতগতির ইন্টারনেট। কিন্তু অনেক গ্রাহকই বলছেন, তা তারা পাচ্ছেন না।অনিতা নামের একজন জানাচ্ছেন, শহরের মধ্যে পেলেও উপজেলা পর্যায়ে তারা প্রায় কখনোই ফোরজি সেবা পাননা।
“যেমন ধরুন জন্ম-নিবন্ধনের কানেকশন সব সময় পাওয়া যায়না, যেহেতু একবারে একটা চাপ পড়ে, দেখা যায় তখন সার্ভারে সমস্যা দেখা দেয়।”
তিনি বলছেন, “ফোরজি থাকলে ওইটা ভালোভাবে করা যায়। অনলাইন ভিত্তিক যে কাজগুলো, আবেদন থেকে শুরু করে সবগুলো ভালোভাবে করতে পারি। থ্রিজি তো স্লো।” “শহরের দিকে গেলে ফোরজি পাওয়া যায়, কিন্তু গ্রামের দিকে আমরা প্রায় কখনোই সেটা পাই না।”
ফোরজিতে কী সুবিধা পাবার কথা?
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যখন ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়, তখন দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো বলেছিল, এই নেটওয়ার্কে গ্রাহকরা সুপার ফাস্ট ডাউনলোডিং, মিউজিক স্ট্রিমিং পাওয়া যাবে।
সেই সঙ্গে ফুল এইচডি ভিডিও স্ট্রিমিং সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন গ্রাহক।এছাড়া ফোরজির মাধ্যমে নিখুঁত ভিডিও কলিং সুবিধাও পাবার কথা গ্রাহকের।ফোরজি নেটওয়ার্ক চালুর সময় সরকার বলেছিল, “হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকটিভিটির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।”
গ্রাহকরা কি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন?
এখন বিটিআরসির নতুন রিপোর্টে যখন দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরে চারটি বড় শহরে যথাযথ ফোর-জি ইন্টারনেট সেবা দিতে পারছে না মোবাইল কোম্পানিগুলো, তখন প্রশ্ন উঠেছে গ্রাহক কি তাহলে প্রতারিত হচ্ছেন?
ফোর-জি সেবায় গ্রাহকদের অন্তত সাত এমবিপিএস ডাউনলোড স্পিড পাবার কথা, একজন গ্রাহক ফোরজি সেবা পাবার আশায় নতুন করে একটি সিম কিনছেন, কিন্তু তার সেই আশা, আকাঙ্ক্ষার পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে।
অথচ দেশের বড় মোবাইল কোম্পানিগুলোর ৬৪টি জেলাতেই ফোরজি সেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলছে।একে ‘স্রেফ প্রতারণা’ বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) সভাপতি গোলাম রহমান।
“গ্রাহক অবশ্যই প্রতারিত হচ্ছে এক্ষেত্রে। আমাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো নানা ক্ষেত্রে যে সেবা দেবার কথা বলে তা তারা দিচ্ছে না” – বলেন তিনি।
“এখন গ্রাহক চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারে, কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক সময় বিচার পায় না।”
“বিভিন্ন সময় মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ভোক্তারা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছেন এখনো করছেন। প্রথমদিকে কিছু জরিমানাও হয়েছে।”
অপারেটররা কী বলছে?
বাংলাদেশে এই মূহুর্তে যে তিনটি মোবাইল কোম্পানি ফোরজি সেবা প্রদান করছে, তারা কেউই প্রতারণার অভিযোগ মানতে রাজি নয়।
এর মধ্যে গ্রামীনফোন ও বাংলালিংক বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।কিন্তু আরেক অপারেটর রবি’র কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি বিভাগের প্রধান শাহেদ আলম বলছেন, ফোরজি সেবা তারা ঠিকই সব জেলায় দিচ্ছেন, কিন্তু স্পিড বা গতি সবখানে সরকারের বেঁধে দেয়া সীমা অনুযায়ী দিতে পারছেন না
তিনি বলেন, “সরকারের শর্ত অনুযায়ী আমরা কভারেজ দিচ্ছি, কিন্তু আমরা বেঁধে দেয়া স্পিড দিতে পারছি না দুটো কারণে।”
“এক, পৃথিবীর কোন দেশেই মিনিমাম স্পিড ধরে দেয়া হয় না, কারণ মোবাইলে ফিক্সড কোন স্পিড দেয়া সম্ভব না। এখন মিনিমাম ৭ এমবিপিএস পর্যন্ত স্পিড দিতে হলে আমাকে নেটওয়ার্ক দিতে হবে ১০ এমবিপিএসের।”
“আবার আমার বিনিয়োগ বাড়বে যখন দেখবো ঐ নির্দিষ্ট এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে ফোরজি উপযোগী মোবাইল হ্যান্ডসেট রয়েছে আমার নেটওয়ার্ক ব্যবহারের জন্য। না হলে তো কোন কাজ হবে না।”মি. আলম বলছেন, বর্তমানে মোবাইল কোম্পানিগুলো ত্রিশ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ ব্যবহার করছে।
কিন্তু সরকারের বেঁধে দেয়া ৭ এমবিপিএস পর্যন্ত স্পিড দিতে হলে ১০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম লাগবে। সেটি সরকার বরাদ্দ দিচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্থ প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বা ফোরজি সেবা চালু করে মোবাইল কোম্পানিগুলো।
বিটিআরসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে নয় কোটি ২০ লাখ মানুষ।এদের মধ্যে সাড়ে আট কোটির বেশি গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। -বিবিসি