২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের স্তর পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী উন্নত- সমৃদ্ধ সোনর বাংলা গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগান সংবলিত এ বাজেট পেশ করেন।
বাজেট পেশের একপর্যায়ে অসুস্থ অর্থমন্ত্রী বক্তব্য দিতে অসুবিধা বোধ করায় সংসদনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পক্ষে বাজেট বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, এ ছাড়া, এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক বাজেট ঘাটতি এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৬৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে আজ দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এর পরই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেটে সম্মতি প্রদান করেন।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আজ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের এ মেয়াদের প্রথম বাজেট। এবারও সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতিতে এ বাজেট পেশ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বিকেল ৩টা ৮ মিনিটে বাজেট বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘জাতি স্বাধীনতার ৫০ বছর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে, জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দুর্লভ মুহূর্ত। সুখী, সমৃদ্ধ কল্যাণমুখী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে দিন বদলের সনদ রূপকল্প ২০২১ সফলভাবে বাস্তবায়ন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার আজীবন লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, জাতির কাছে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার।’
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের অন্যান্য শহীদ, চার জাতীয় নেতা, মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিতা দুই লাখ মাবোন এবং অন্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে সঙ্গে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদে রাষ্ট্রপতির গ্যালারিতে বসে বাজেট বক্তব্য শোনেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ বিভিন্ন বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী ও দাতাসংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্ট আমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারাও সংসদ ভবনে উপস্থিত থেকে বাজেট বক্তৃতা শোনেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে মোট এক লাখ ৪৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা মোট বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মধ্যে মানব সম্পদ খাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে এক লাখ ২৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো খাতে এক লাখ ৬৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, বৃহত্তর যোগাযোগ খাতে ৬১ হাজার ৩৬০ কোটি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা রয়েছে। সাধারণ সেবা খাতে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ২৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) এবং বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ ৩৩ হাজার ২০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৬৩৫ শতাংশ। সুদ পরিশোধ বাবদ ৫৭ হাজার ৭০ কোট টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ। নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের দশমিক ২৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।