চৌগাছা প্রতিনিধি: যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আল-আমিনের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূত পদোন্নতি নেয়া, নিজের অফিস রুমে সরকারি টাকায় এসি লাগানো, চিকিৎসক ডরমেটরি জোরপূর্বক ব্যবহার, সহকর্মীদের বেতন বিল করতে উৎকোচ গ্রহণ, চিকিৎসকদের সাথে খারাপ ব্যবহারসহ দূর্নীতির নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি এমএলএস হিসেবে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট নড়াইল জেলা হাসপাতালে যোগদান করেন। সেখান থেকে একই পদে বদলি হন যশোর সিভিল সার্জনের ডাকবাংলোতে। এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অফিস সহকারী হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদেন। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিপত্র না মেনে ১৭ জুলাই ২০১৮ তারিখে পস্বা/খুবি/শা-৩/২০১৮/১০৮৪ স্মারকে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান সহকারী হয়েছেন।
সরকারের সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী অর্থাৎ বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ ‘বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়/ সিভিল সার্জনের কার্যালয়/ জেনারেল হাসপাতাল/ সদর হাসপাতাল/ ক্লিনিক, ইন্সস্টিটিউশন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইত্যাদি কার্যালয় সমূহ’ অংশে কিভাবে কর্মচারীরা পদোন্নতি পেতে পারেন তার বর্ণনা করা হয়েছে। গেজেটের ৩৩৭৮ পৃষ্ঠার ৯৯ ও ১০০ ক্রমিকে এবিষয়ে বর্ণনায় বলা হয়েছে, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক বা গ্রেড ১৬ এর স্টোর কিপার পদে কেউ অন্যূন ৫ বছর চাকুরি করে উচ্চমান সহকারী/ হিসাব রক্ষক/ ক্যাশিয়ার পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। উচ্চমান সহকারী, হিসাব রক্ষক বা ক্যাশিয়ার পদ হতে জেষ্ঠতার ভিত্তিতে বদলির মাধ্যমে প্রধান সহকারী হতে পারবেন। কিন্তু আল-আমিন এমএলএসএস থেকে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদেই পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর থেকে উচ্চমান সহকারী, হিসাব রক্ষক বা ক্যাশিয়ার পদে পদোন্নতি পেতেই যেখানে কমপক্ষে পাঁচ বছর চাকুরীর অভিজ্ঞতা দরকার। সেখানে তিনি এই পদে পদোন্নতি না পেয়েই সরাসরি প্রধান সহকারী হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার উচ্চমান সহকারী, হিসাব রক্ষক বা ক্যাশিয়ার থেকে বদলির মাধ্যমে প্রধান সহকারী হওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি বদলী না হয়ে পদোন্নতি নিয়ে একই কর্মস্থল চৌগাছা হাসপাতালেই যোগদান করেছেন। জানা যায় পদোন্নতি পেতে তিনি ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী হয়েই তিনি হাসপাতালের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম একহাতে গোপনে করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার দূর্নীতি যেন ফাঁস না হয় সেজন্য হাপাতালের অফিস সহকারীদের বাদ দিয়ে নিজের জন্য আলাদা করে আলীসানভাবে একটি অফিস রুম সজ্জিত করেছেন। এছাড়া হাসপাতালের অন্য কোন চিকিৎসক বা কর্মকর্তাদের রুমে, এমনকি কনফারেন্স রুমেও এয়ার কন্ডিশন (এসি) না থাকলেও নিজের রুমে তিনি এসি লাগিয়েছেন। চিকিৎসক ডরমেটরিতে চিকিৎসক বা প্রথম শ্রেণির কোন কর্মকর্তার নিচে কেউ না থাকার কথা থাকলেও প্রধান সহকারী আল-আমিন জোরপূর্বক চিকিৎসক ডরমেটরিতে রাত্রিযাপন করেন।
হাসপাতালে ৩ জন অফিস সহকারীর পদ রয়েছে। ২ জন কর্মরত রয়েছেন। প্রধান সহকারী আল-আমিন তাদের পরিসংখ্যানবিদের ছোট্ট একটি রুমে বসতে বাধ্য করেন। অফিস সহকারীরা অভিযোগ করেছেন এরআগে তারা প্রধান সহকারীর সাথে একইরুমে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিয়মানুযায়ী হিসাব রক্ষকের পোস্টিং থাকলে সেখানে কোন অফিস সহকারী ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারীর দায়িত্বে থাকতে পারেন না। কিন্তু দায়িত্ব হস্তান্তর তো দূরের কথা, আল-আমিন অফিস রুম দখল করে রাখায় হাসপাতালের হিসাব রক্ষক জাকির হোসেনের বসার কোন কক্ষ নেই। জাকির হোসেনকে একেক দিন একেক জনের চেয়ারে বসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে হয়। জাকির হোসেনের অভিযোগ, অফিসের অর্থনৈতিক কার্যক্রম দেখভাল করার কথা হিসাব রক্ষকের। অথচ নিজের অবৈধ উপার্জন কমে যাওয়ার ভয়ে জাকির হোসেনকে সে দায়িত্ব বুঝিয়েও দিচ্ছেন না। হিসাব রক্ষকের কাজ করার সুযোগ না থাকায় হাসপাতালে কর্মরত অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসিয়াল কাজে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
প্রসূতি সেবায় উপজেলা পর্যায়ে দেশ সেরা এই হাসাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ডিমান্ড সাইন্ড ফাইনান্সিয়াল (ডিএসএফ) প্রোগাম চালু আছে। দেশের মাত্র ৩২ টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এটি চালু রয়েছে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে দরিদ্র গর্ভবতী মা’য়েদের সহযোগিতা করা হয়। প্রোগামটিতে বছরে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হয়। যা একজন অফিস সহকারীকে দেখভালের জন্য ডিএসএফ নীতিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও প্রধান সহকারী আল-আমিন নিজেই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ডিএসএফের কাজ করছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ডিএসএফের টাকা কৌশলে বিভিন্নভাবে আত্মসৎ করার। আর এসব কারনে অফিস সহকারীদের কোন কাজই তিনি করতে দিচ্ছেন না।
সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের চিকিৎসক ডরমেটরিতে শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা অর্থাৎ চিকিৎসকদের আবাসনের কথা থাকলেও সেখানে কোন জোরপূর্বক দখল করে এমএলএসএস থেকে অবৈধ উপায়ে প্রধান সহকারী হওয়া আল-আমিন রাত্রি যাপন করেন। চিকিৎসক ডরমেটরিতে প্রধান অফিস সহকারীর রাত্রি যাপন সম্পূর্ন অবৈধ।
এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সিনিয়র চিকিৎসকদের রুমে কোন এসি নেই। এমনকি হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে দীর্ঘদিন ধরে এসি লাগানোর পরিকল্পনা থাকলেও অর্থের কারনে লাগানো সম্ভব হয়নি। অথচ প্রধান সহকারী আল-আমিন তার নিজ রুমে এসি লাগিয়েছেন। যেখানে দিনে ৩০০-৩৫০ জন আউটডোরে রোগি দেখা কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রুমে এসি নেই, এমনকি হাসপাতালের কনফারেন্স রুমেই এসি নেই সেখানে একজন কেরানির রুমে এসি এ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রশ্ন থাকলেও আল-আমীনের কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ে কেউ কোন কথা বলেন না।
সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ, অফিস সহকারীসহ সাতজন স্বাস্থ্য সহকারীর নিকট থেকে বেতন বিল করার নামে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে আদায় করেন প্রধান সহকারী আল-আমিন। অন্যথায় বেতন- বিল করবেন না বলে হুমকি দেন। তিনি টাকা না দিলে কোন কাজ করে দেন না অফিসের কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। টাকা না দিলে বিভিন্ন স্টাফদের ট্রেনিং আটকিয়ে দেয়া, ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশনের ফাইল আটকে দেয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করে হাজার হাজার টাকা আদায় করছেন। প্রায়ই তিনি সিনিয়র স্টাফদের সাথে অসাদাচরণ করে থাকেন। যার কারণে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসন্তষ্ট ও বিরক্ত থাকলেও তার অসাদচরণের স্বীকার হওয়ার ভয়ে কেউ কিছু বলেন না।
অভিযুক্ত প্রধান সহকারী আল-আমীন বলেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাকে পদোন্নতি দিয়েছেন। আর আমি তো চলতি দায়িত্বে রয়েছি। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে আমাকে সরিয়ে দিতে পারেন। হিসাব রক্ষক জাকির হোসেনকে ১৫ নম্বর রুমে একটি চেয়ার টেবিল দেয়া হয়েছে। ডরমেটরীতে আমি অফিসের কাজের জন্য টিএটচওর নির্দেশে ছিলাম, এখন আর থাকি না। এসি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লাগিয়েছেন। এটা তো হাসপাতালেরই একটি কক্ষ। আমার ব্যক্তিগত অফিস না। আমি কারো কাছ থেকে উৎকোচ চেয়ে নেইনি।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার নাহিদ সিরাজ বলেন, আগে চিকিৎসক ডরমেটরীতে থাকতেন। আমি নিষেধ করে দেয়ার পর এখন হয়ত থাকেন না। তবে তার ব্যবহারের জিনিসপত্র এখনও সেখানে রয়েছে। নিয়মানুযায়ী তিনি এসি লাগাতে পারেন না। এটা আমার অগোচরে হয়েছে। অনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন আমার স্টাফরা মৌখিকভাবে বলেছেন। তবে লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় খতিয়ে দেখা হয় নি। তিনি চিকিৎসকদের সাথে রুঢ় আচরণ করেন বলে সহকর্মীরা আমাকে মৌখিক ভাবে বলেছেন।