বাঙালী জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্ধোধনের পর আমার মা‘সহ পরিবারের অন্যান্য কতিপয় সদস্যদের নিয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে নানা বাড়ি গিয়েছিলাম। পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে নানা বাড়ি, দাদা বাড়ি যাওয়ার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তবে এবারের পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে নানা বাড়ি যাওয়ার আনন্দই আলাদা। শিবচর থানার মাদবরের চর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর পাড়েই নানাবাড়ি। আমার জানামতে তিনবার পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে নানাবাড়ী। নদীর ভাঙনে ভিটাবাড়ি, ক্ষেত-খামার সবকিছু হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে যায়। নানা বাড়ির সেই আভিজাত্য ও জৌলুস না থাকলেও আপ্যায়নের কমতি ছিল না।
প্রায় ৪৫ বছর পূর্বে দ্বিতীয়বার নদী ভাঙ্গনের পর আমার নানা (মা‘র বাবা) ইন্তেকাল করেছেন। তারপরও ঘুরে দাড়িয়েছিল পরিবারটি। কিন্তু তৃতীয়বার নদী ভাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে পুরো পরিবার। একজন মাত্র নানা ছিলেন, মা‘র ছোট চাচা, যিনি মা‘র কয়েক বছরের বড়, তিনিও গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইন্তেকাল করেছেন। সেই নানার একমাত্র পুত্রের আপ্যায়নের ধরন দেখে বুঝা যায়নি নানারা কেউ বেঁচে নেই। এটাই নানা বাড়ি বেড়ানোর আনন্দ।
পদ্মা সেতু অতিক্রম করেই মা‘কে বললাম, ‘মা, মাত্র ৮ মিনিটে এই বিশাল পদ্মা পাড় হলাম‘। উত্তরে মা বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। শেখ হাসিনার কারণেই পদ্মা সেতু হইচে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শেখ হাসিনারে নেক হায়াত দারাজ করুক। একশ বছর বাঁচাইয়া রাখুক‘। ঐদিনই সন্ধ্যায় ঢাকা ফিরে আসার পর ছোট ভাই মা‘কে জিজ্ঞাসা করলো, ‘মা, চাচার বাড়িতে কেমন বেড়াইলা?‘ প্রতুত্তরে মা বললেন, ‘মুখে যাইই খাইছি, কিন্তু পদ্মা ব্রিজ দেইখ্যা মনডা ভইরা গেছে‘।
বাবার চাকরির সুবাদে শিশুকাল থেকেই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে আসছি। দাদাবাড়ি কুতুবপুর, নানাবাড়ি মাদবরের চর। দুটোই ঢাকা থেকে পদ্মা নদীর অপর পাড়ে হওয়ায় প্রতিবছরই এক বা একাধিকবার বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে আসতাম। সুতরাং খরস্রোতা বিশাল পদ্মা নদী পারাপারে আনন্দ-বেদনার অনেক স্মৃতি রয়েছে। এমন একটা সময় ছিল, যাত্রী বহন বা মালামাল পরিবহনে বিশাল আকারের নৌকা ব্যবহৃত হতো। যতটুকু মনে পড়ে যাত্রী বহনের বড় নৌকাকে বলা হতো ‘পালা নৌকা‘। মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত বড় নৌকাকে বলা হতো ‘ঘাসি নৌকা‘। এছাড়া দূরপাল্লায় যাতায়াতে ধনী শ্রেণির মানুষেরা কারুকাজ করা নিজস্ব মালিকানাধীন বড় নৌকা ব্যবহার করতো, যা ‘গয়না নৌকা‘ হিসেবে পরিচিত ছিল।
বর্তমানে দূরপাল্লায় যাতায়াতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত সুন্দর সুন্দর একতলা দোতলা বড় বড় বাস ব্যবহার করা হয়। এই পরিবহনগুলো এতটাই বড় যে, যানজট এড়াতে, ঢাকা মহানগরের ছোট ছোট রাস্তায় চলাচল করে না। পরিবহন কোম্পানিগুলো ছোট আকারের বাস বা মিনিবাসে শহরের বিভিন্ন টিকিট কাউন্টার থেকে যাত্রী সংগ্রহ করে নিজস্ব টার্মিনালে নিয়ে বড় বাসে তুলে দেয়। ঠিক তেমনি, সেকালে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছোট ছোট দ্রুতগতি সম্পন্ন নৌকা দিয়ে ঢাকাগামী যাত্রীদের সংগ্রহ করে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে নির্দিষ্ট ঘাটে অপেক্ষারত ‘পালা নৌকা‘য় তুলে দেওয়া হতো। তারপর বিশাল আকারের ঐ পালা নৌকা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হতো। বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সকল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকাগামী লঞ্চগুলো পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকা আসতো। আমরা নানাবাড়ি বাড়ি থেকে রওয়ানা হলে মাদবরের চর ঘাট থেকে লঞ্চে উঠতাম, দাদাবাড়ি থেকে রওয়ানা হলে ‘লাউখোলা‘ ঘাট বা ‘গস্তির হাট‘ থেকে লঞ্চে উঠতাম। সূর্যোদয়ের আগেই লঞ্চঘাটে আসতে হতো। বালুমাটির লঞ্চঘাট। প্রতিনিয়ত নদীভাঙনে লঞ্চঘাট প্রায়শই পরিবর্তন হতো। লঞ্চের কর্মচারিরা ১২-১৪ ইঞ্চি চওড়া একটি লম্বা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সুবিধামত স্থানে ঘাট হিসেবে ব্যবহার করে যাত্রী উঠানামার ব্যবস্থা করতো। খুবই সাবধানে সেই সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে উঠতে হতো। অসাবধানতাবশত পা পিছলে পরলে সরাসরি পদ্মায়। সাথে সাথেই ঢেউয়ের আঘাতে পদ্মার স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। লঞ্চে উঠতে সহায়তার জন্য একটি লম্বা বাঁশের লগি ব্যবহার করা হতো। বাঁশের সগির গোড়াটি ঘাটে বালির মধ্যে গেঁথে দিয়ে বাঁশের সরু প্রান্তটি ধরে রাখতো লঞ্চে থাকা কর্মচারী। বাঁশের লগিটির আগা সরু হওয়ায় উহা দুলতে থাকতো। এছাড়া বৃষ্টির দিন হলে কাঠের সিঁড়িটি পিচ্ছিল হয়ে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যেত। লঞ্চগুলি কখনই আড়াআড়িভাবে পদ্মা নদী পাড়ি দিত না। লঞ্চ স্রোতের প্রতিকূলে কয়েক কিলোমিটার উজান বেয়ে কোনাকুনিভাবে ঢেউ কেটে কেটে উজানেই বিপরীত পাড়ের দিকে এগুতে থাকতো, এবং একই সঙ্গে লঞ্চ স্রোতের টানে ভাটির দিকেও যেতে থাকতো। শেষ পর্যন্ত লঞ্চ বিপরীত পাড়ে পৌঁছতো বটে, তবে গন্তব্যের চেয়ে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে। তারপর লঞ্চ উজান ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতো।
একবার ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে আমাদের বহনকারী লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের জশিলদা বরাবর উজানে এসে পদ্মা নদী পাড় হওয়ার জন্য উজানের দিকে রওয়ানা হয়েছিল। নদীতে বড় বড় ঢেউ। আমি আপার কেলাস কেবিনের সামনে ডেকের উপর সারেং এর রুমের দরজা বরাবর দাড়িয়ে ছিলাম। ঢেউ এত উঁচু ছিল যে, মাঝে মাঝে সারেং সাহেবের ডেস্ক থেকে আকাশ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। লঞ্চ কর্মচারীরা ডেকের উপর সামনে পিছনে থাকা সকল যাত্রীদের নিজ নিজ আসনে যেতে বাধ্য করেছিলেন। লঞ্চ কোনক্রমেই কোনাকুনি অবস্থান নিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, লঞ্চটি সামান্য কোনাকুনি হলেই ঢেউ এসে লঞ্চটিকে কাঁত করে ফেলবে। এমনি পরিস্থিতিতে সারেং খুবই দক্ষতার সাথে অস্বাভাবিক ঢেউ ও প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবেলা করে উজানেই এগুতে এগুতে কয়েক ঘন্টা লড়াই করে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে খরস্রোতা পদ্মা নদী পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিল। স্মৃতিতে এমনি বিপদসংকুল ঘটনাও রয়েছে অনেক। কূয়াশাচ্ছন্ন রাতে ফেরি পারাপারে ডুবু চরে আটকা পড়ার স্মৃতির পাশাপাশি স্পীডবোটে পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে বিপদাপন্ন হওয়ার স্মৃতিও রয়েছে।
একবার মা‘কে নিয়ে মাদবরের চর থেকে ঢাকা আসার পথে কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটে এসে জানলাম, ফেরী ছাড়তে দেরী হবে। আমাদের তাড়া আছে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছতে হবে। উপায় কি? দ্রুতগতির স্পীডবোটে পাড় হওয়া যায়। কিন্তু এমনিতেই মা‘ নদী ভয় পান। কারন, মা‘র বয়স তখন ৮-৯ বছর। আমার মায়ের বর্ননা অনুযায়ী, নদীর পাড়ে বাড়ী হওয়ার সুবাদে ধান সিদ্ধ করার জন্য বাড়ীর মহিলারা নদী থেকে পানি আনতো। ফুফুদের সাথে আমার মা ছোট কলস নিয়ে পদ্মা নদীতে পানি আনতে গিয়েছিলেন। ফুফুরা পানি নিয়ে ফিরছেন। নিজ কলসের পানি ঘোলা হওয়ায় মা তাঁর ফুপুকে বলেছেন, ‘ আমার কলসির পানি ঘোলা কেন‘? পরিস্কার পানির জন্য বায়না ধরছিলেন তিনি। একজন ফুফু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুই যাইয়া পরিস্কার পানি নিয়া আয়‘। যেই কথা সেই কাজ। মা তার কলস নিয়ে ফিরে গেলেন নদীতে। পদ্মা নদীর পানিতে সাধারণত অধিক পরিমাণে পলি মাটি মিশ্রিত থাকে বিধায় পদ্মার পানি ঘোলা থাকে। তথাপি শিশুদের অবুঝ মন। পরিস্কার পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এক পা এগিয়ে কলস ভরতে গিয়ে স্রোতের টানে কলসসহ ভেসে গেলেন আমার মা। সকলেই পানির কলস কাঁখে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছেন। হঠাৎ সকলের নজরে এসেছে, জরিনা (আমার মা‘র নাম জরিনা) ফিরে নাই। নাই নাই নাই। এরমধ্যে ফসলের মাঠ থেকে আমার নানা ফিরে এসেছেন। তিনি মেয়েকে খুঁজছিলেন আদর করে মেয়ের মাথার চুল আচড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জরিনাকে। এমন সময় ফুফুরা বললেন, ‘জরিনাতো গাঙে (নদীতে) পানি আনতে গেছিল‘। নানা চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘ আরে খাইছে তো, আমার জরিনারে গাঙেই নিয়া গেছে। কে কোতায় আছস গাঙ পাড় আয়‘। তাৎক্ষণিকভাবে নানা কয়েকজনকে সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে গেলেন। নদীর দিকে তাকিয়ে ভাটিতে খুঁজতে লাগলেন তাঁর প্রিয় কন্যাকে। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন নদীর ঢেউয়ের সাথে চুলের মত কিছু একটা ভাসছে। দু/একজন বলেছিলেন, কচুরিপানা উল্টে গিয়ে ভাসলে অমন দেখা যায়। কিন্তু নানা‘র মন সায় দিচ্ছিল না। তিনি বললেন, ‘কচুরীপানা হোক, যাই হোক ঐ চুলগুলো ধর, ঐডাই ধর, ঐডাই আমার জরিনা‘। এই কথা বলেই নানা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এরই মাঝে অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনেকে নদীর তীর থেকে বড় বড় বাঁশ বা লগি ফেলে সহযোগিতা করছিল। নানা এক হাতে মেয়েকে ধরেছেন, আরেক হাত দিয়ে বাঁশ বা লগি ধরেছেন। নদীর পাড়ে থাকা লোকজন বাঁশ টেনে তাদের কিনারে এনেছিলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেক চেষ্টা তদবিরে সেযাত্রায় মা বেঁচে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু নদীর প্রতি আমার মা‘এর যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছিলো, তার এতবছর পরও পুরোপুরি কাটেনি।
মাওয়া ঘাটে দ্রুত ফিরে যেতে সময়ের স্বল্পতার কারণে পদ্মা নদী পাড় হওয়ার জন্য শেষপর্যন্ত মা‘সহ স্পীডবোটে চড়ে বসলাম। এমনিতেই স্পীডবোট গুলো নদী পারাপারে প্রতিযোগিতা করে চলে। কাওড়াকান্দি শাখা নদী থেকে মূল পদ্মায় নামতেই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুটি স্পীডবোট ধাক্কা লাগে এবং ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষাকাল, টইটুম্বুর নদীতে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়া ছোট স্পীডবোটে থাকা যাত্রীদের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সকলেই আল্লাহর নাম জপতে থাকে। স্পীডবোট ভাসতে ভাসতে পাশ্ববর্তী বালুচরে পৌঁছলে যাত্রীরা দ্রুত চরে নেমে পরে। স্পীডবোট চালক মেরামত করে বোট চালু করে বটে। কিন্তু যদি মধ্যনদীতে এমন ঘটনা ঘটতো, কি হতো? ভাবতেই গা শিউরে উঠে। এমনি পরিস্থিতিতে নদীর প্রতি ভীত আমার মা‘র মনের অবস্থা কি হতে পারে? যে সকল যাত্রীরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লঞ্চে ঢাকা রওয়ানা হতো, তারা সাধারণত তিনবেলার খাবার সঙ্গে নিয়ে আসতো। টিফিন ক্যারিয়ারে বাটিতে বাটিতে বিভিন্ন ধরনের রসালো খাবার। ঘ্রাণে জিভে পানি এসে যায়। এসব খাবার লঞ্চে বসে খেতে আলাদা একটা আনন্দ। অনেকটা পারিবারিক পিকনিকের আমেজ। আমার খুবই ভাল লাগতো ইলিশ মাছ ভাজা, ডিম ভাজা, মসুর ডালের চড়চড়ি, সাথে ইলিশের সাথে ভাজা শুকনো মরিচ।
এছাড়া লঞ্চে পদ্মা পারাপারে বিভিন্ন ধরনের ‘স্ট্রিট ফুড‘ জাতীয় খাবারের বর্ননা না দিলেই নয়। লঞ্চের পিছনে ডেক থেকে দুই হাতের উপর ভর করে নীচে নামতেই ডান দিকে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। সেখানে ‘কুকিজ‘ নামে ‘S’ shape এর টোস্ট বিস্কুট এর মত খাবার পাওয়া যায়। লঞ্চের যাত্রীরা কড়া মিষ্টি চা দিয়ে ভিজিয়ে খেতে খুবই পছন্দ করেন। বিশেষ করে শীতকালে রাতের লঞ্চের যাত্রীরা। ফুটবল খেলার মাঠে দর্শকরা যেমনিভাবে আগ্রহ সহকারে চিনাবাদাম চিবোতে পছন্দ করে, ঠিক তেমনি লঞ্চের যাত্রীরা কোড়ানো নারিকেল ও চিনি মিশিয়ে বিশেষ ধরনের ‘মচমচে চিড়া ভাজা‘ খুবই আগ্রহ নিয়ে খায়।
লঞ্চের কেরানী সাহেব, যিনি ভাড়া আদায় করার সময় টিকিট দিয়ে থাকেন, উনার টিপিক্যাল ব্যবহার এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। লঞ্চের কেরানী সাহেবের ভাড়া আদায় করার পদ্ধতি ছিল খুবই ইন্টারেস্টিং। ভাড়া আদায় বিষয়টি যাত্রীদের নিকট ‘টিকিট কাটা‘ হিসাবে পরিচিত। কেরানী সাহেব সাধারণত প্রতিটি ফ্লোরের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে প্রতি জনে জনে ভাড়া আদায় করেন। কাজের সুবিধার্থে দুই/একজন সহকারী তার সাথে রাখেন। যে সকল যাত্রীরা ভাড়া কম দিতে চেষ্টা করেন বা প্রকৃত ভাড়া দেওয়ার মত সামর্থ্য থাকতো না, তারা পালিয়ে বেড়াতো, কম ভাড়ায় টিকিট সংগ্রহ করার বিভিন্ন ফন্দিফিকির করতো। পরবর্তিতে কেরানী সাহেবের নির্দিষ্ট রুমে সাক্ষাৎ করে যে কোন উপায়ে টিকিট সংগ্রহ করতো। কারন টিকিট ছাড়া লঞ্চ থেকে নামার কোন উপায় নাই। লঞ্চ নির্দিষ্ট ঘাটে পৌঁছার পর কেরানী সাহেব তার বিশেষ ধরনের চামড়ার ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে লঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির সামনে সহকারীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যাত্রীরা নামার সময় সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে টিকিটটা জমা দিতে হতো। যদি কোন যাত্রী যে কোন কারণে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি এমন হতো, তবে ঐ মূহুর্তে কাছেই দাড়ানো কেরানী সাহেবের নিকট ভাড়া দিয়ে নেমে যেতেন। আর যদি ভিন্ন কোন ছলচাতুরি করার চেষ্টা করতেন তবে, সময় নষ্ট না করে কেরানী সাহেবের সহকারীরা ঐ যাত্রীকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেওয়ার নজিরও রয়েছে।
তবে আমার জানামতে, ব্যতিক্রম ঘটনাও রয়েছে। বর্তমানে অতি উচ্চ শিক্ষিত বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী জনৈক অধ্যাপক ছাত্রজীবনে টিকিট না দিয়ে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পরার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি ছলচাতুরি করেননি, উনার কাছে টিকিট কাটার মত প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা ছিল না। হয়তো জীবনে আর কখনো লঞ্চে বা নৌকায় বা ফেরীতে পদ্মা নদী পার হতে নাও পারি। কিন্তু যখনই মোটরগাড়িতে চড়ে মাত্র ৭-৮ মিনিটে পদ্মা নদী পার হবো, তখন স্মৃতির ভান্ডারে জমে থাকা অসংখ্য স্মৃতি মনে দোলা দিবে চিরদিন।
সাবাস শেখ হাসিনা। চিরকৃতজ্ঞ তোমার প্রতি। তোমার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার জন্যই বাঙ্গালী জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক ‘পদ্মাসেতু‘ আজ বাস্তবতা।
তোমার পিতা দিয়েছে দেশ, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, তুমি দিয়েছো পদ্মা সেতু। আমাদের টাকায় আমাদের পদ্মা সেতু, এটাই আমাদের গর্ব।
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন, ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ।