মোঃ আমিন আহমেদ, সিলেটঃ নানা জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প। আগামী একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হতে পারে। অনুমোদন পেলে এ প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তাও কেটে যাবে।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ নকশা চূড়ান্তের কাজ শেষ হয়েছে। প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। অর্থায়ন থাকবে সরকারেরও। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আগামী জুলাইয়ে এ প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ শুরু হবে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা নিয়ে দীর্ঘ জটিলতার অবসান ঘটেছে। পরিকল্পনা বিভাগ থেকে প্রকল্পের বেশ কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। তা চূড়ান্ত করে ইতিমধ্যে ডিপিপির চূড়ান্ত খসড়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তা অনুমোদনের জন্য একনেকে উঠবে।
মন্ত্রণালয়সূত্র জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে মূল কাজে অর্থাৎ সড়ক, সেতু, কালভার্ট, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণকাজে ব্যয় হবে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। এ প্রকল্পের জন্য ৯৮৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকার আলাদা করে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরুও হয়েছে। জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ ইতিমধ্যে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য সাতটি জোনের মধ্যে পাঁচটির প্রস্তাব তৈরি করেছে।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কটি সাত জেলার ওপর দিয়ে নির্মাণ হবে। এ কারণে প্রতিটি জেলাকে একটি জোন ধরে সাতটি প্রস্তাব তৈরি করে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের অর্থায়নের পুরোটাই ব্যয় হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। সড়ক বিভাগ জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জানুয়ারিতে। কিন্তু নানা জটিলতায় ডিপিপি চূড়ান্ত করতে লম্বা সময় লেগে যায়। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর ডিপিপি তৈরি করে তা একনেকের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর সেখান থেকে দফায় দফায় প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ফেরত পাঠায়।
অবশেষে সবকিছু ঠিক করে ডিপিপির খসড়া চূড়ান্ত করে একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর সূত্র জানিয়েছেন, প্রকল্পের ডিপিপি ও নকশা আপডেটের কাজ শেষ করে এডিবির কাছে পাঠানো হলে তারা খসড়া ডিপিপির বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী একনেক বৈঠকে ডিপিপিটি উত্থাপন করা হবে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২১০ কিলোমিটার চার লেন প্রকল্পে থাকবে মহাসড়কের দুই পাশে দুটি সার্ভিস লেন। নির্মাণ হবে ছয়টি রেল ওভারপাস। এ ছাড়া বেশ কিছু আন্ডারপাস থাকবে। মহাসড়কের দুই পাশে দেওয়া হবে বেষ্টনী। যাতে সাধারণ মানুষ, গবাদি পশু সড়কে উঠতে না পারে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া সার্ভিস লেনের কোনো যানবাহন যেন মূল সড়কে উঠতে না পারে। ইউটার্ন থাকবে নির্দিষ্ট দূরত্বে। বিশেষ করে বাজার ও আরবান এলাকায় যেখানে জনবসতি আছে সেসব স্থান চিহ্নিত করে নির্মাণ করা হবে ইউটার্ন। এ প্রথমবারের মতো দেশের কোনো মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা হবে পলিমার মটিফাইড বিটুমিন। যার ফলে সড়ক হবে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী।
প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পর প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে। মোট ১৩টি প্যাকেজে প্রকল্পের পূর্তকাজ সম্পন্ন হবে। আগামী জুলাইয়ে প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ শুরু হবে বলে আশা করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। প্রসঙ্গত, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে ২০১৩-১৪ সালে এডিবি প্রথম সমীক্ষা করে। এরপর এ মহাসড়কের কাজ কারা করবে এ নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হলে এডিবি আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। শুরুতে এডিবির সঙ্গেই কথা হচ্ছিল সরকারের। কিন্তু মধ্যে চীনের অর্থায়নে জিটুজি ভিত্তিতে এ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। কথা ছিল ২০১৮ সালের প্রথম দিকেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কিন্তু চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রকল্পের জন্য যে ব্যয় প্রস্তাব করেছিল তা সওজ অধিদফতরের প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। তাই তাদের প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হলে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।
একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও সেখান থেকে আরও কিছু সংশোধনী চেয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সড়ক বিভাগ তা সুবিন্যস্ত করে ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। কিন্তু প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার পর তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী প্রকল্পটি অনেক ব্যয়বহুল উল্লেখ করে এর জন্য বাইরের কোনো অর্থায়ন পাওয়া যায় কি না দেখতে নির্দেশ দেন। এর পরপরই প্রকল্পটি পুরোপুরি ঝুলে যায়। অথচ কথা ছিল সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এরপর এ প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে আবারও আগ্রহ দেখায় এডিবি।