অনেক পরিচয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার সম্পাদক। ঐ পত্রিকা অফিসেই কর্মরত অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন ঘাতকের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। দেশে কোন পত্রিকার সম্পাদক হত্যাকান্ডের এটিই প্রথম ঘটনা। পুলিশের তদন্তে সাতক্ষীরার সবচেয়ে প্রভাবশালীদের নাম উঠে আসে এই হত্যা মামলার আসামী হিসেবে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশের দক্ষিণ-
পশ্চিমাঞ্চেলের বিভিন্নস্থানে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠে। সেই থেকে লায়লা পারভীন সেঁজুতির সংগ্রামী জীবন শুরু। একদিকে বাবার হত্যাকান্ডের বিচারের দাবী নিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে রাজপথে থাকা। অপরদিকে তার বাবার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়া। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে বীরমুক্তিযোদ্ধা স.ম আলাউদ্দিন ব্যতিক্রমধর্মী পরিকল্পনা নিয়ে “বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল এন্ড কলেজ” নামে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর নামে জেলায় এটিই ছিল প্রথম কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স.ম আলাউদ্দিন এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্ত্রিত হয়।
লায়লা পারভীন সেঁজুতি শুধু শিক্ষকতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন নি। তাকে দায়িত্ব নিতে হয় পিতৃহারা ৬ ভাই বোনের একটি পরিবারের। পিতার মৃত্যুর সময় তার একমাত্র ভাইটির বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া শেখানোসহ মায়ের পাশাপাশি তাকেও অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হয়। এসবের ধারাবাহিকতায় তিনি ২০০২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী এডভোকেট আবুল কালাম আজাদও একজন সংগ্রামী মানুষ। গত ৩৫ বছর ধরে সাতক্ষীরাতে নাগরিক আন্দোলন, ভূমিহীন আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। তিনি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের বারবার নির্বাচিত সাবেক সভাপতি।
লায়লা পারভীন সেঁজুতি ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স.মআলাউদ্দিনের তৃতীয় কন্যা লায়লা পারভীন সেঁজুতি ১৯৯১ সালে সাতক্ষীরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৯৩ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৯৫ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করার পূর্বেই পিতার মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।
বাবার রাজনৈতিক দর্শন বুকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। ২০১৩ সালে নগরঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক এবং ২০১৬ সালে জেলা মহিলা রীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সদস্য সচিব হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন লায়লা পারভীন সেঁজুতি।
২০১৩-১৪ সালে যুদ্ধাপারাধীদের বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা প্রতিরোধে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করছেন জেলা স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও দৈনিক পত্রদূতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও। আওয়ামী লীগ পরিবারের এই কর্মী ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের জন্য তৃণমূলে কাজ করে মানুষের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চাইবেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সাথে। তিনি বলেন, আমার বাবা স.ম আলাউদ্দিনের বৃহৎ রাজনৈতিক কর্মকা-ই আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে রাজনীতিতে আসতে। বাবা সব সময় একটি জিনিস বোঝানোর চেষ্টা করতেন- একমাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব।
তিনি সাতক্ষীরার সামগ্রিক উন্নয়ন, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি ও শিল্প সম্প্রসারণে জন্য কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তিনি দেখিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালবাসা ও দর্শন। মানুষের অধিকারের কথা বলতে ১৯৯৫ সালের ২৩ জানুয়ারি দৈনিক পত্রদূত পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাতক্ষীরাকে বাণিজ্য নগরীতে পরিণত করার লক্ষ্যে তিনি চেম্বার অব কমার্স, ভোমরা স্থল বন্দর প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাতক্ষীরার মানুষের উন্নয়নে যে চিন্তা ভাবনা- তা তিনি নিজ কর্মকা-ের মধ্য দিয়েই রেখে গেছেন।
লায়লা পারভীন সেঁজুতি বলেন আমি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। দলের জন্য-মানুষের জন্য কাজ করছি। সাতক্ষীরা জেলা এখনো জামায়াত-শিবির মৌলবাদ অধ্যুষিত জেলা হিসেবে তার পরিচিতি মুছতে পারেনি। তাছাড়া জামায়াত-শিবিরের শক্তির মূল ভিত্তি তাদের নারী সংগঠন। সেই সংগঠন ভাঙার দৃশমান কোন উদ্যোগই আমরা এখনো নিতে পারিনি। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও শহরী অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটা সবদিকে ছড়াতে না পারলে ওদেরকে মোকাবেলা করে ওদের শিকড় উপড়ানো যাবে না। আমি সেজন্য কাজ করছি। দলের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হতে পারলে এ কাজের গতি আরো বাড়াতে পারবো বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সাতক্ষীরা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে ডজনের অধিক প্রার্থীর মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে সেঁজুতি বলেন, যারা মনোনয়ন চাচ্ছেন তারা অবশ্যই যোগ্য। এতগুলো যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ একসাথে কাজ করলে আগামীতে সাতক্ষীরার নারী সমাজ মৌলবাদী অপশক্তিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরার মৌলবাদী গালি মুছে ফেলা যাবে।