প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
টিকেট নিয়ে টানাটানি। অনেকে বেশী দামে টিকেট কেটে স্টেডিয়ামে। এসেছেন স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে প্রিয় বাংলাদেশের খেলা দেখতে। অনেকে বাংলাদেশের জার্সি পরিহিত। আগ্রহটা একটু বেশী অন্য দিনের তুলনায়। এর কারণ কি? কারণ আফগান অধিনায়কের চ্যালেঞ্জ। তারা নাকি একটি ম্যাচ জিতবে তাও বাংলাদেশের বিপক্ষে। লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশিদের এটা ভাল লাগেনি তাইতো প্রিয় দলকে সাপোর্ট দিতে সোজা সাউদাম্পটনে চলে এসেছে সবাই। তাছাড়া আরও কারণ হল আফগানদের ঘূর্ণি বলের যাদু।
আবার ছিল উইকেট নিয়ে রহস্য। খেলা হবে ঘূর্ণি বলের জাদুতে। যেখানে আবার আফগানরা এগিয়ে। বিশেষ করে বিশ্ব ক্রিকেটে এই সময়ের সেরা লেগ স্পিনার রশিদ খানকে খেলতে যে কোনো ব্যাটসম্যানই সমীহ করে থাকেন। আগের ম্যাচে ভারতের মতো শক্তিশালী দলকেও তারা ৫০ ওভার খেলতে দিয়ে ৮ উইকেটে মাত্র ২২৪ রানে আটকে রেখেছিল। যদিও মাচটি আফগানরা জিততে পারেনি। নানা কারণেই চাপে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দুরন্ত বাংলাদেশকে রুখবে কে? ম্যাচসেরা সাকিবের বোলিং কারিশমায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি হার মেনেছে ৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে। বাংলাদেশের ৭ উইকেটে করা ২৬২ রানের জবাব দিতে নেমে আফগানরা যেতে পেরেছিল ৪৭ ওভারে ২০০ রান পর্যন্ত। এই জয়ে বাংলাদেশের সেমিতে যাওয়ার কক্ষ পথেই টিকে থাকল। এখন ২ জুলাই বার্মিংহামে জিততে হবে ভারতের বিপক্ষে। এরপর ৫ জুলাই হারাতে হবে পাকিস্তানকেও। তারপর তাকাতে হবে পয়েন্ট টেবিলের দিকে। ৭ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা পাঁচে।
কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে আফগানরা দুর্বার হলেও একদিনের ক্রিকেটে যে তা কাজে আসে না তা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বিশ্বকাপে। বাংলাদেশের বিপক্ষে পেল আরেক দফা। একমাত্র ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ ছাড়া বাকি সব ম্যাচেই হেরেছে বাজেভাবে। আসরে একমাত্র জয়হীন দলও তারা। আফগানদের ললাটে এমন শোচনীয় হার এঁকে দিয়েছেন বলা যায় সাকিব একাই। ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব (৫১) এই ম্যাচেও হাফসেঞ্চুরি করেন। আমাদের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ব্যাটিংয়ে ভাল করলেও এতদিন বলিংয়ে অনেকটা ম্রিয়মাণ ছিলেন কিন্তু কাল তিনি দিনটিকে সাকিবময় করে তুলে একে একে ৫ উইকেট তুলে নেন। ১০ ওভার বোলিং করে ২৯ রানে ৫ উইকেট। ব্যাট হাতে আসরে দুই সেঞ্চুরি আর তিন হাফসেঞ্চুরির সাথে এবার যোগ হলো ম্যাচে ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তিও। ব্যাটে-বলে ম্যাচটি হয়ে ওঠে সাকিবময়। ব্যাট হাতে ৫১ রানের ইনিংস খেলার পথে গড়েছিলেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এক হাজার রান। ডেবিড ওয়ার্নারকে পেছনে ফেলে ৪৭৪ রান করে আবার ওঠে যান সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায়। তখনই আবার ওঠে যান বিশ্বকাপে এক হাজার রান ও ২৫ উইকেট পাওয়া ক্রিকেটার হিসাবে সবার উপরে। পরে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে বল হাতে বিশ্বকাপে নেন ৫ উইকেট। তার ২৯ রানে ৫ উইকেট এবারের আসরে দ্বিতীয় সেরা বোলিং। সেরা বোরিং ইংল্যান্ডের আর্চারের ২৭ রানে ৫ উইকেট। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেয়া ক্রিকেটার হিসাবে ভারতের যুবরাজের পর গড়েন দ্বিতীয় নজির। আর বিশ্বকাপের কোনো আসরে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেয়া ক্রিকেটার হিসাবে তৃতীয় দৃষ্টান্ত গড়ে স্থাপন করেন আরেকটি নজির। তার আগে এ রকম কীর্তি ছিল দুই ভারতীয় কপিল দেব ও যুবরাজ সিংয়ের। ৫ উইকেট নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে সাকিবের উইকেট সংখ্যা হলো ১০টি আর সেরাদের তালিকায় তিনি এখন আটে। এভাবেই সাকিবময় হয়ে ওঠে ম্যাচটি। চার বিশ্বকাপে সাকিবের উইকেট ৩৩টি। তার উপরে আছেন ১৮ জন। ৭১ উইকেট নিয়ে সবার উপরে আছেন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকগ্রা।
ভারত ও আফগানিস্তানের ম্যাচ যে উইকেটে হয়েছিল, সেই উইকেটেই বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচ হওয়াতে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের করা ৭ উইকেটে ২৬২ রান অনেক বেশি নির্ভার হয়ে উঠে। প্রতিপক্ষ আফগান হওয়াতে আরো বেশি নির্ভার ছিল বাংলাদেশ। কারণ এবারের আসরে আফগানদের ব্যাটিংয়ে ছিল করুণ হাল। কোনে ম্যাচেই তারা আড়াইশ উপরে ছিল না। ভারতের বিপক্ষে যে রকম সাবধানে শুরু করেছিল। একপর্যায়ে ২ উইকেট হারিয়ে শতরান অতিক্রম করলেও পরে ১ বল বাকি থাকতে অলআউট হয়েছিল ২১৩ রানে। বাংলাদেশের বিপক্ষেও তারা এগুচ্ছিল একই পরিকল্পনায়। এবারে তারা ২ উইকেট হারিয়ে শতরান অতিক্রম করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভারতের বিপক্ষে দুই পেসার মোহাম্মদ সামী ও বুমার মিলে ধ্বংস চালিয়েছিলেন। এই ম্যাচে সাকিব একাই। সাকিব বল হাতে নিয়েই সাফল্য পাওয়ার আগে পেসাররা ভালো সূচনা এনে দিয়েছিলেন। ব্যাটিংয়ে পাওয়ার প্লের ১০ ওভার বাংলাদেশের তিন পেসার মাশরাফি, মোস্তাফিজ ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন মিলে কোনো উইকেট নিতে না পারলেও রান দিয়েছিলেন মাত্র ৪০। পরে ১১ নম্বর ওভারে আক্রমণে আসেন সাকিব। প্রথম ওভারেই উইকেট। অপরদিকে মেহেদী হাসান মিরাজ ও মোসাদ্দেক হোসেন উইকেট না পেলেও রান নিতে দেননি। ফলে পরের ২০ ওভারে রান আসে মাত্র ২৯। এভাবেই রান সংগ্রহে আফগানরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। এদিকে সাকিব এক ওভারে দুই উইকেট তুলে নিয়ে আফগানদের আরো বেশি করে চাপে ফেলে দেন। সেই চাপ আরো ঘনীভ‚ত হয় পরে আরো ২ উইকেট তুলে নিলে। তিনি একে একে শিকার করেন গুলবাদিন নাইব (৪৭), রহমত শাহ ( ২৪), আসগর আফগান (২০), মোহাম্মদ নবী (০) ও নজিবুল্লাহ জারদানকে (২৪)। প্রথম ছয় উইকেটই ছল স্পিনারদের। অপরটি নিয়েছিলেন মোসাদ্দেক হাসমতউল্লাহ শাহিদিকে আউট করে। স্পিনারদের সাফল্য দেখে পরে জ্বলে উঠেন পেসারারও। শেষ তিন উইকেট ভাগাভাগি করে নেন মোস্তাফিজ (২/৩২) ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (১/৩৩)। অপর উইকেটটি ছিল রানআউট।
এর আগে টসে হেরে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। মুশফিকুর রহিমের ৮৩, সাকিবের ৫১, তামিমের ৩৬, মোসাদ্দেকের ৩৫ ও মাহমুদউল্লাহর ২৭ রান বোলারদের পায়ের তলার মাটি অনেক শক্ত করে দিয়েছিল। টস জেতা না হওয়াতে বাংলাদেশ দলও পরিকল্পনায় আনে পরিবর্তন। সৌম্য খুব একটা ভালো করতে না পারার পাশাপাশি ডান-বাম কম্বিনেশনের কারণে লিটন দাসকে তামিমের সঙ্গে করে উদ্বোধন করতে পাঠানো হয়। এর আগে বাংলাদেশ সেরা একাদশে দুটি পরিবর্তন আনে সাব্বির ও রুবেলকে বাদ দিয়ে ইনজুরিমুক্ত হওয়াতে মোসাদ্দেক ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে ফিরিয়ে আনা হয়। এ দিন বাংলাদেশের ব্যাটিংও ছিল প্রশংসনীয়। পরীক্ষার প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের মতোই। শুরুতে লিটন মারমুখী শুরু করে বিতর্কিত আউট হলেও তামিম ও সাকিব ছিলেন সাবধানি। তামিম এমনিতেই নিজের খেলার ধরনে পরিবর্তন এনেছেন। এবার সাকিবও নিজেকে গুটিয়ে নেন। ৫৩ বলে ৪ চারে ৩৬ রান করে তামিম আউট হন। সাকিব ৬৬ বলে এবারের আসরে তার পঞ্চম পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেন। যেখানে বাউন্ডারি ছিল মাত্র একটি। তবে হাফসেঞ্চুরি করার পর আর বেশি দূর যেতে পারেননি। এক রান যোগ করেই তিনি মুজিবুরের বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন। পরে মুশফিক প্রথমে মাহমুদউল্লাহ, পরে মোসাদ্দেককে নিয়ে দলের রান বাড়িয়ে নেন। ইনজুরি নিয়ে মাহমুদউল্লাহ (২৭) তাকে সঙ্গ দিয়ে যোগ করেন ৫৬ রান। মোসাদ্দেক সঙ্গ দিয়ে যোগ করেন ৪৪ রান। ৫৬ বলে অর্ধশত রান করা মুশফিক চারটি চার ও ১ টি ছয়ের সহযোগিতায় সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে গেলেও ৮৭ বলে ৮৩ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেছেন। শেষের দিকে মোসাদ্দেক ২৪ বলে চার চারে ৩৫ রান করে ইনিংসের শেষ বলে আউট হন। মুজিবুর ৩৯ রানে নেন ৩ উইকেট। রশিদ খান ১০ ওভারে ৫২ রান দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য। গুলবাদিন নাইব ৫৬ রানে নেন ২ উইকেট।