পৃথিবীতে সমস্ত সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে শিক্ষক নামক নির্লোভ, নিরহংকারী, সৎ, সামাজিক ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অবস্থান। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে এই পদটিকে যেমন সম্মানের আসনে রাখা হয়, তেমনি সম্মান ও মর্যাদা ধরে রাখার প্রয়োজনীয় রসদও যোগান দেওয়া হয় যথাযথ।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব প্রতিষ্ঠান, যুগোপযোগী আইন, শিক্ষিত তদারক পর্ষদ, শ্রেণি উপযোগী পাঠ্য পুস্তক, সহায়ক ডিজিটাল শ্রণিকক্ষ, দক্ষ মনিটরিং, শিক্ষকদের দৈনিক পারস্পরিক বুঝাপড়া, সাম্প্রতিক বিষয়ের উপর ভিন্ন ভিন্ন সেমিনার, কাউন্সিলিং, পাশ্ববর্তী দেশ সমূহের শিক্ষা পদ্ধতি, উন্নত দেশ সমূহের শিক্ষা পদ্ধতি জানা-বুঝা-প্রয়োগ করার জন্য কান্ট্রি টু কান্ট্রি প্রশিক্ষণ এসবের নিয়মিত ব্যবস্থা করা হয়।
দরিদ্র দেশসমূহে শিক্ষাকেই উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে বাৎসরিক পরিকল্পনা, বাজেট, শিক্ষকদের বেতন আপডেট করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান আর তুরস্কের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত, ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অতি অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শুধু বিদেশি অনুদান শিক্ষায় ব্যয় করে। পাশ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটানের দিকে একটু নজর দিলে দেখবেন ওরা এগিয়ে যাচ্ছে বহুগুণ। কারণ ওদের শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা আমাদের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশী।
অথচ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ উন্নয়নশীলের তকমা লাগিয়েও বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে। শিক্ষা সূচকে বিশ্বের প্রায় তলানিতে লক্ষ লক্ষ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে। শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যম শিক্ষকরা এখানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে গর্ব করে, অতি আগ্রহের সহিত বাপ-দাদার মুখ থেকে শুনে আসা সম্মানের পেশায় প্রবেশ করে। আর প্রয়োজনীয় রসদের অভাবে নিজে পুষ্টিহীন হয় এবং পুষ্টিহীন জাতি তৈরি হয়।
অথচ এ শিক্ষকদের সমস্ত অর্থনৈতিক দূর্দশা, সুষ্ঠ পরিবেশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করলে, আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা করলে পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষকদের তুলনায় একটুও দূর্বল হবেনা অনেকাংশে এদের তুলনায় সবল হবে।
আমরা ইচ্ছে করলেই পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি, লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের বছরের পর বছর নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে খাওয়াতে পারি। কিন্তু, আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মানে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারিনা, বেসরকারি শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারিনা, একটা দক্ষ, উন্নত ও যোগ্য প্রজন্ম গঠন করে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারিনা।
যেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন লোকসান দিয়ে বৃহৎ বৃহৎ প্রজেক্টে মার খাচ্ছি নিয়মিত, হেরে যাচ্ছি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়। সেখানে শিক্ষাখাতে সামান্য ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে কি ভূমিকা রাখা যায়না?
একবারও কি মনে হয়না একটা প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকলে আজ এগিয়ে যেত সোনার বাংলা, এগিয়ে যেত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ?
কেন এ অনীহা? কারা পরামর্শ দিচ্ছে এভাবে শিক্ষকদের অবহেলা আর তাচ্ছিল্য করে দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে নিতে? নিশ্চয়ই এরা দেশের মঙ্গল চায়না, জাতির ভাল চায়না, সরকারের সুনাম চায়না, দক্ষ নেতৃত্ব চায়না। এরা বিশ্বচক্রের সাথে হাত মিলিয়ে এদেশ ও দেশের ভবিষ্যতকে নষ্ট করতে সরকারকে বারবার বিচ্যুৎ করছে। আজ শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নির্যাতনের মাধ্যমে সুকৌশলে শিক্ষাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন এ বিষয়ের কর্তাব্যক্তিরাই।
আজ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সর্বোচ্চ পরিশ্রমী পেশার এ শিক্ষা সৈনিকগুলো অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করে নিজের ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতেই জীবন শেষ করছে তারা। অথচ জাতীয়করণ করা হলে এ শিক্ষা সৈনিকেরা নব উদ্যমে নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রমের বিনিময়ে এ জাতিকে শিক্ষিত আধুনিক উন্নত ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারতো।
পেট্রোল না থাকলে যেমন গাড়ি অচল তেমনি শিক্ষক না বাঁচলে শিক্ষা অচল। শিক্ষক বাঁচাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই সোনার বাংলায় সোনার মানুষ গড়ে উঠবে।
লেখক,
প্রদীপ কুমার দেবনাথ
শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট।
[বি.দ্র.- মুক্তমতামতের জন্য সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী নন। ]