লাদাখ সীমান্তে চীনের বাড়তি সেনা মোতায়েনকে কেন্দ্র ফের ভারত ও চীনের সেনা সদস্যদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ।
দুদেশের মাঝে যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলএসি রয়েছে, গত কয়েকদিনে সেই এলএসি বরাবর বিভিন্ন স্থানে দুদেশের সেনারা সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
এর আগে গত মে মাসের একবার দুই দেশের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিলো। পরবর্তীতে দুদেশের স্থানীয় কমান্ডাররা আলোচনা করে বিষয়টি মিটিয়েছিলেন। তবে প্রকৃতপক্ষে উত্তেজনা কমেনি, বরং বেড়েছে।
সম্প্রতি দুই দেশই পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিশেষ করে প্যাংগং ও গালয়ান উপত্যকায় সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছে। চীন বাঙ্কার তৈরি করেছে। অস্থায়ী পরিকাঠামোও তৈরি করেছে। সেখানে তারা দুই থেকে আড়াই হাজার সেনা বাড়িয়ে নিয়েছে। ভারতও একই রকমভাবে সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছে। দুই দেশের সেনা একেবারে মুখোমুখি। উত্তেজনা রয়েছে। ২০১৭ সালে ডোকলামের পরেও এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যেটা এ বার পূর্ব লাদাখে হয়েছে।
কেন আচমকা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই ধরনের সামরিক উত্তেজনা তৈরি হল, তা পর্যবেক্ষকদেরও বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে কোনও সুনির্দিষ্ট ও সুচিহ্নিত আন্তর্জাতিক সীমানা নেই – তার বদলে আছে কয়েক হাজার কিলোমিটার লম্বা একটি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, যা লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, গত দু-তিনসপ্তাহের ভেতর চীনা সেনাবাহিনী এই ‘এলএসি’ অন্তত চার জায়গায় অতিক্রম করে অবস্থান নিয়েছে।
সেই জায়গাগুলো হল লাদাখের প্যাংগং সো বা প্যাংগং লেক, গালওয়ান নালা ও ডেমচক – আর সিকিমের নাকু লা।
ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা তার ব্লগে লিখেছেন, এই প্রথম সমগ্র গালওয়ান ভ্যালিকেই চীন নিজেদের বলে দাবি করছে।
শুক্লার কথায়, ‘এই অবৈধ প্রবেশগুলো হয়েছে বিরাট একটা জায়গা জুড়ে। উত্তর লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ লাদাখের ডেমচক – আর সেখান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে সিকিমের নাকু লা পাস পর্যন্ত।’
‘যা থেকে বোঝা যায় এই গোটা অভিযানটার পরিকল্পনা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে খুবই উঁচু মহলে, এমন নয় যে স্থানীয় কমান্ডাররা তাদের ইচ্ছেমতো এগুলো করছেন।’
শুধু অবস্থান নেয়াই নয়, গত কয়েকদিনের মধ্যে চীনা সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বেশ কয়েক দফা মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে।
দু’পক্ষেই বেশ কয়েক জন সেনা আহত হয়েছেন, এমন কী কয়েকজন ভারতীয় সেনাকে চীন বেশ কিছুক্ষণ আটকে রেখেছিল বলেও জানা গেছে – যদিও ভারত পরে তা অস্বীকার করেছে।
গত শুক্রবার ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে লাদাখে গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসেছেন, ওই সেক্টরের সেনাদের এলএসি’র দিকে সরিয়েও নেয়া হয়েছে।
লাদাখ সফরের আগে জেনারেল নারাভানে বলেছিলেন, ‘আসলে যেহেতু এলএসি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়, তাই দুপক্ষই এই সীমান্তকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে।’
‘দুদেশের সেনারাও ততদূরই টহল দেয়, যতদূর পর্যন্ত তারা নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। আর যখনই দুদেশের বাহিনী একই সময়ে একই জায়গায় গিয়ে পৌঁছয়, তখন এরকম সংঘাত প্রায়ই ঘটে থাকে।’
‘লাদাখে আর সিকিমে যে একই সময়ে সংঘাত হল এটা নেহাতই দৈব্য ঘটনা – এটা থেকে খুব বেশি কিছু খোঁজার মানে হয় না।’
তবে এর কদিন পরেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক কড়া বিবৃতি দিয়ে জানায়, ভারতীয় সেনার স্বাভাবিক টহল বা পেট্রলিং প্যাটার্নকে বাধা দিয়ে চীনই বরং সীমান্তে নানা কর্মকান্ড চালাচ্ছে।
১৯ মে বেজিইংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা ট্রেসপাসিং বা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনেছিল – দিল্লি সেটা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে।
২০১৭ সালে ডোকলাম ভ্যালিতে চীন ও ভারতের সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে।
লাদাখের এই সামরিক উত্তেজনা বহরে অনেক বেশি এবং এটাও খুব সহজে মিটবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না।
সূত্র: বিবিসি।