আজ মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংস গণহত্যার তৃতীয় বর্ষপূর্তি । বর্বর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে প্রতিবেশী ভারতেও আশ্রয় নেয় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। প্রাণে রক্ষা পেলেও ভারতে এখন জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন তারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নতুন মাত্রায় আগ্রাসন শুরু করে মিয়ানমাররা। দেশটির পশ্চিম রাখাইন থেকে পালাতে বাধ্য হয় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। যাকে পাঠ্যবইয়ের উল্লেখিত গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে জাতিসংঘ।
মিয়ানমার কর্তৃক নাগরিকত্ব অস্বীকার, জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, ধর্ষণের শিকার এবং ভূমি হারিয়ে ৮ বছর আগে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন ৩০০ রোহিঙ্গার একটি দল।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউ.এন.এইচ.সি.আর-এর তথ্য মতে দেশটিতে বর্তমানে ১৮ হাজার ৯১৪ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে আশ্রয় শিবিরে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন-যাপন করছিলেন। কয়েক বছর আগেও জীবন বাঁচাতে পেরে খুশি ছিলেন তারা। কিন্তু জাতিবিদ্ধেষী প্রচারণা বেড়ে যাওয়ায় অনিরাপত্তায় ভুগছেন এখন।
রোহিঙ্গাদের প্রতি ভারত সরকারের বৈরি মনোভাব ফুটে কয়েক মাস আগে। তিনটি গ্রুপে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম এবং মণিপুর দিয়ে ৩০ জন রোহিঙ্গা ভারতের প্রবেশের চেষ্টা করে। পরে তাদের আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় নয়াদিল্লি।
নয়াদিল্লির কালিন্দি কুঞ্জ অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয়ে আছেন অনেকে। নিম্নাঞ্চল হওয়ায় মাঝারি বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় তাদের শিবির। স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা আলি জোহর জানান, গেলো এক বছর ধরে আমরা খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারী এবং রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণাসহ নানা পদক্ষেপ।
করোনা মহামারী বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। মহামারীর আগে বিভিন্ন নিম্নমানের কারখানায় কোনোরকম কাজকর্ম করে দিন চলতো তাদের। করোনারোধে লকডাউন জারি হলে কর্মক্ষেত্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেকার হয়ে যান তাদের অনেকে। তারপর থেকে বাধ্য হয়ে দরিদ্রতা আর দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসের পর থেকে অনিশ্চয়তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বেড়েছ জাতিবিদ্বেষ। অনেকে এখন পালাতে চাইছে। অথবা ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা ভাবছে। জাতিবিদ্ধেষী প্রচারণা এবং সরকারের পুরানো নীতির পরিবর্তনের কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি বাড়ছে। বলেন আলী জোহর।
‘নতুন নাগরিকত্ব আইন আরো ভয়াবহতা ডেকে এনেছে’
সংশোধিত নতুন নাগরিকত্ব আইনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
নতুন আইনে বলা হয়, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি, জৈন এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউ যদি পার্শ্ববর্তী তিন দেশ থেকে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আশ্রয় নিয়ে থাকে তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে।
নতুন আইনের সুবিধা নিতে রোহিঙ্গা কমিউনিটির কেউ কেউ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দি ইকোনোমিকস টাইমস এক প্রতিবেদন জানিয়েছে, আফগান এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে।
এ পর্যন্ত ১৬০ জন রোহিঙ্গা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। কমিউনিটি নেতা মোহাম্মদ সাবির বলেন, যারা ধর্মান্তরিত হয়েছেন তারা মিয়ানমার ছেড়ে আসার আগেই নিজেরে পূর্বের ধর্ম ত্যাগ করেছে।
এক বিবৃতিতে ভারতের খ্রিস্টান রোহিঙ্গা কমিউনিটি জানিয়েছে, নাগরিকত্ব পাওয়ার লোভে কেউ ধর্মান্তরিত হয়নি। বলা হয়, ভারতে যেসব রোহিঙ্গা খ্রিস্টধর্ম চর্চা করছে ২০০৮ সাল থেকে মিয়ানমার তাদের খ্রিস্টান হিসেবে বিবেচনা করতো।
২০১৭ সাল থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেছে অনেক রোহিঙ্গা। জোহর বলেন, ভারত থেকে ৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্ত ঝুঁকি উপেক্ষা করেই তারা পাড়ি দিয়েছে। শুধুমাত্র ভারত সরকার কর্তৃক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর হাত থেকে রক্ষা পেতে।
জোহর বলেন, বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে। তারপরও রোহিঙ্গারা তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে-এমন আশঙ্কায় ভীত। তারা মনে করে মিয়ানমারে ফেরার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। ভারতীয় সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক।
ইউ.এন.এইচ.সি.আর মিয়ানমার থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া অর্ধেক রোহিঙ্গাদের তালিকা নয়াদিল্লির সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু ভারত জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে সই করা দেশ না হওয়ায় তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেয়নি।
‘নির্যাতিত জাতি’
২০১২ সালের জাতিগত সংঘাতের পর থেকে রোহিঙ্গারা ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছেন। সংঘাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। রোহিঙ্গাদের ‘বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি’ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের চালানো বর্বরতা থেকে বাঁচতে বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়ে আছে বলেও জানানো হয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ২৪ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অন্তারিও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
২৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ১ লাখ ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়েছে। ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা: দি আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স নামের প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়, ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী, শিশু মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১ লাখ ১৫ হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে আরো ১ লাখ ১৩ হাজার বাড়িঘর।
সূত্রঃ- সময় নিউজ