প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড ১৯) বিস্তার ঠেকাতে নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে সংক্রমণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন, ইয়োলো জোন ও গ্রিন জোনে ভাগ করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কোনো এলাকাকে রেড, ইয়েলো বা গ্রিন জোনে ভাগ করার পর সেই এলাকায় কোন কোন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারবে এবং কিভাবে এসব কর্মকাণ্ড চলবে।
সব জোনেই প্রযোজ্য যা কিছু
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, তিনটি জোনের জন্যই কিছু কিছু বিষয় সাধারণ রয়েছে। অর্থাৎ এই বিষয়গুলো যেকোনো স্থানেই মেনে চলতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেকের মাস্ক পরা, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে তিনটি জোনেই।
এছাড়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, তার চিকিৎসা ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা; কন্টাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থাও থাকবে সব জোনেই। একইভাবে সব জোনেই বন্ধ থাকবে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চালু থাকবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় জরুরি পরিষেবা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও থাকবে মাঠে।
রেড জোন
যেসব এলাকায় লাখে ৩০ জনের বেশি সংক্রমিত ব্যক্তি থাকবেন, সেসব এলাকাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে । এসব এলাকায় কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প উন্মুক্ত থাকতে পারে, তবে শহর অঞ্চলে এই ধরনের কর্মকাণ্ড চালানো যাবে না। এই জোনের আওতায় কর্মজীবীরা বাড়ি থেকে কাজ করতে পারবেন, বাইরে যেতে পারবেন না। কোনো ধরনের জনসমাগমও করা যাবে না। কেবল প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার কাজেই বাইরে চলাচল করা যাবে।
প্রস্তাবনায় এসেছে, এই জোনের মধ্যে কোনো ধরনের গণপরিবহন থামতে পারবে না। একইসঙ্গে কোনো জোনের মধ্যে রেলপথ ও নদীপথ থাকলে সেখানেও কোনো স্টপেজ থাকবে না। এই জোনে মালবাহী পরিবহন কেবল রাতে চলাচল করতে পারবে।
রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত গ্রামীণ এলাকায় মুদির দোকান ও ফার্মেসি খোলা রাখা গেলেও কোনো ধরনের রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান ও টং দোকান খোলা রাখা যাবে না। গ্রামীণ এলাকায় খোলাবাজার চালানো গেলেও শহরে কোনোভাবেই বাজার খোলা রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে হোম ডেলিভারির প্রস্তাবনা করা হয়েছে নগর এলাকার জন্য। মুদির দোকান, বাজার ও ফার্মেসির ক্ষেত্রেও হোম ডেলিভারি পদ্ধতির প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
রেড জোন চিহ্নিত এলাকায় মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানে কেবল খাদেম বা কর্মচারীরাই থাকতে পারবেন বলে প্রস্তাব এসেছে। এছাড়াও রেড জোন এলাকায় টপআপ ও এমএফএস সেবা খোলা রাখা গেলেও ব্যাংকিং খাতে কেবল এটিএম বুথ খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। যদি এই জোনে কোনো কৃষি বা ফার্মিং থাকে, তবে এসব জায়গায় যারা যুক্ত তাদের কাজের পরিষেবা বৃদ্ধি করা হতে পারে শিফট ভিত্তিতে।
রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রেড জোনে স্থানীয়ভাবে ২৪ ঘণ্টা নমুনা সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত বুথ স্থাপন করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষত দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিষেবা চালু রাখার প্রস্তাবনা থাকছে। এছাড়াও কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির হোম কোয়ারেনটাইন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রস্তাবনাও থাকছে। বিভিন্ন দরিদ্র অঞ্চলের জন্য পর্যাপ্তভাবে স্থানীয়ভাবে ও অতিরিক্ত আইসোলেশন কেন্দ্র থাকার প্রস্তাবনাও থাকছে।
ইয়েলো জোন
কোনো এলাকায় লাখে ৩ থেকে ২৯ জন সংক্রমিত থাকলে সেই এলাকাকে ইয়েলো জোন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হতে পারে। এই জোনে আভ্যন্তরীণভাবে কৃষিকাজ ও ফার্মিংয়ে যারা যুক্ত, তারা এই জোনে কাজ করতে পারবেন। তবে কারখানা ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে শিফট বৃদ্ধি করে বা ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ চালানোর প্রস্তাবনা থাকছে। জনসমাকীর্ণ কারখানারর ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কর্মী কাজ করার প্রস্তাবনা থাকছে। এই জোনে ৫০ শতাংশ মানুষকেই বাড়ি থেকেই কাজ করার সুযোগ দিতে প্রস্তাবনা থাকছে।
তবে এসব এলাকাতেও রেড জোনের মতোই জনসমাগম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া চলাফেরা না করার প্রস্তাবনাও থাকছে।
ইয়েলো জোনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সড়ক পথে তিন চাকার যানবাহনে এক জন যাত্রী ও চার চাকার যানবাহনে ৫০ শতাংশ আসন ব্যবহার করার প্রস্তাবনা থাকতে পারে। এই জোনে একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রেল ও নৌপথে যাত্রী পরিবহন করা যাবে। মালবাহী পরিবহন এই জোনের ভেতরে ও বাইরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে পারবে।
ইয়েলো জোনে মুদির দোকান ও ফার্মেসির পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার দোকানও খোলা রাখা যাবে। তবে রেস্তোরাঁর দোকানের ক্ষেত্রে টেকআউট সার্ভিস চালু রাখার প্রস্তাবনা করা হয়েছে, যেন ভেতরে কোনো জনসমাগম না হয়। এই জোনে ব্যাংকিং খাতে বিকল্প দিন হিসেবে চালু রাখা এবং টপআপ ও এমএফএস সার্ভিস খোলা রাখার প্রস্তাবনা থাকছে। এই জোনে দূরত্ব বৃত্ত নিশ্চিত করে মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানগুলোতে প্রার্থনা করা যেতে পারে বলেও প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
ইয়েলো জোনে রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবনা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে হোম কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত আইসোলেশন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করার প্রস্তাবনাও থাকছে।
গ্রিন জোন
লাখে ৩ জনের নিচে কোনো এলাকাতে করোনায় আক্রান্ত হলে সেই এলাকাকে গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই জোনে কৃষিকাজ ও ফার্মিং এবং কারখানা ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প খোলা রাখা যেতে পারে বলে প্রস্তাবনা থাকছে। ৩০ জনের বেশি মানুষের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খোলা রাখা ও সাধারণে চলাচলেও তেমন বিধিনিষেধ থাকছে না এই জোনে। শপিং মল বন্ধ থাকলেও এই জোনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন ও মালবাহী পরিবহন চালু রাখতে দেওয়া হতে পারে। অন্যান্য দোকানপাট ও বাজার খোলা রাখার সুযোগও থাকছে এই জোনে।
আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই এলাকায় টপআপ ও এমএফএস সেবার পাশাপাশি ব্যাংকিংও চালু রাখতে বলা হতে পারে। এই জোনে নমুনা সংগ্রহের সহজগম্যতার কথা প্রস্তাবনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে হোম কোয়ারেনটাইন পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত আইসোলেশন কেন্দ্র নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই জোনেও দূরত্ব বৃত্ত নিশ্চিত করে মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানগুলোতে প্রার্থনার ব্যবস্থা চালু রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে আলোচনায়।
কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এসব সিদ্ধান্ত?
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা মুশতাক হোসেনের মতে, বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন ঘোষণা করার পর তা কার্যকরভাবে পালন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় ও কমিউনিটি নেতৃত্বকে সংযুক্ত করতে হবে।
মানুষজন ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন মানছে কিনা তা নিশ্চিত করতে এবং কোয়োরেন্টিনে থাকাদের কাছে খাবার, ওষুধ পৌঁছে দিতে স্থানীয় ভলান্টিয়ার, সমাজ কল্যাণ সমিতি, হাউজিং সমিতির সদস্যদের যুক্ত করা হবে।
কোয়ারেন্টিন করা ব্যক্তিদের তালিকা করা হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের স্থানীয় দোকানের সাথে সমন্বয় করে তাদের বাসায় খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেয়া হবে।
মুশতাক হোসেন বলেন, এই ক্ষেত্রে আমরা টোলারবাগ মডেল অনুসরণ করবো। শুরুর দিকে টোলারবাগে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যখন, তখন এভাবে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তিনি জানান প্রথমদিকে প্রত্যেক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজে প্রত্যেক জেলায় কমিটি ছিল, ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় সেরকম কমিটি তৈরি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে, আবার ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিও থাকবে। আবার জোনভিত্তিক কমিটিও করা হতে পারে।
বিভিন্ন জেলার কমিটিগুলোর আদলে তৈরি হলেও এসব কমিটিতে কীভাবে এনজিওসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে সংযুক্ত করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে জানান মুশতাক হোসেন।
আর যারা এই পুরো কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকবে, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে জানান তিনি। সুত্রঃ বিবিসি ও সারা বাংলা।