ডিবিএন ডেস্কঃ বাংলাদেশে দুর্গাপূজার অষ্টমী থেকে টানা পাঁচদিন ধরে হিন্দুদের বাড়িঘর, পূজা মণ্ডপ ও মন্দির হামলার ঘটনায় চলমান ধারা বজায় রাখতেই যেন গতকাল রাতে আবার রংপুর জেলার পীরগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দিল এবার মৌলবাদীর দল।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক তরুণ ফেসবুকে একটি পোষ্টে ধর্ম অবমাননাকর কমেন্ট করার কথিত অভিযোগে রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া জেলেপল্লীর প্রায় ৩০টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রংপুর জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান।
রোববার রাতে প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টার পর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
“এই খবর পাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই তরুণের বসতবাড়ির আশপাশে অবস্থান করে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। শেষ পর্যন্ত তাকে এবং তাঁর পরিবারকে রক্ষা করা গেলেও হামলাকারীরা তাঁর থেকে দূরের কিছু বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।”
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয় যে, রাত পৌনে ৯টার দিকে তাদের কাছে আগুন লাগার খবর পৌঁছায়। এরপর কোনোরূপ বিলম্ব না করে তারা পীরগঞ্জ থেকে দুটি, মিঠাপুকুর থেকে দুটি ও রংপুর থেকে একটি ইউনিট নিয়ে সেখানে আগুন নেভাতে পৌঁছে যায়। প্রায় সাত ঘণ্টার অদম্য চেষ্টার পর তারা ভোর ৪টা ১০ মিনিটে আগুন নেভাতে সফল হয়।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান যে, পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় ১৫জন মালিকের প্রায় ৩০টি বসতঘর, দুটি রান্নাঘর, দুটি গোয়াল ঘর এবং ২০টি খড়ের গাদা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রংপুর থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে- এ আগুন দিয়েছে ‘মৌলবাদী উগ্রপন্থী জনতা’।
পুলিশ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, “ভালবাসার প্রস্তাব নামে একটি ফেসবুক আইডির প্রোফাইল ফটোতে কাবা শরীফের ছবি ছিল। সেই আইডিতেই কমেন্ট করা হয়। তবে এটা ফেক আইডি হবে বলে আমরা ধারণা করছি – কারণ নাম দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।”
দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন ১৩ই অক্টোবর কুমিল্লা শহরের একটি পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর তা নিয়ে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে শুরু হয় মৌলবাদীদের সহিংসতা। আর এ সহিংসতা শুরুর পর থেকে গত কয়েকদিনে তা ছড়িয়েছিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। এবার এর রেশ ছড়িয়ে পড়লো রংপুরে।
এরপর টানা সপ্তাহব্যপী নোয়াখালী, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। আর পীরগঞ্জের আগে সর্বশেষ শনিবার ফেনীতে হামলা করে এই মৌলবাদীর দল।
রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লীতে লাগা আগুনের কয়েকটি ভিডিও রোববার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে দেখা যায় অন্ধকারের মধ্যে গ্রাম থেকে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা লাল আগুনের লেলিহান শিখা।
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মৌলবাদীদের এই সহিংসতায় গত কয়েকদিনে ঘটে চলেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর অমানবিক অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ, ৭০টির অধিক পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও ঘটছে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। যা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কক্ষনোই প্রাপ্য ছিলো না।
এদিকে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে হিন্দুদের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন। এর বাইরেও ২০১৪ সালে দুজন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন। শ্লীলতাহানি করা হয় আরও চারজনের। এছাড়া ২০১৬, ২০১৭ ও ২০২০ সালে ১০টি হিন্দু পরিবারকে জমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দখলের অভিযোগ ওঠে।