দেশের প্রত্যেকটা খাতে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা লোপাট করেছে বিগত পতিত সরকার ও তার লোকজন। আর অর্থনীতি লুটপাট করা খাতের তালিকায় অন্যতম আইসিটি খাত। জানা গেছে, এই খাতে আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরে নেয়া ২১টি প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি ব্যয় করা হয়েছে। এখনো উদ্যোগ নেয়া হলে এসব প্রকল্প থেকে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব বলে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে আইসিটি খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি।
সম্প্রতি তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। তিনি প্রতিবেদন আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা-দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও তদন্ত কমিটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ওই প্রকল্পগুলোতে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত যেসব অপচয়, অসঙ্গতি, দূর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অচ্ছ্বতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বারবার করার মতো বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি কমিটি পাঁচ দফা সুপারিশও করেছে।
এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে একটি ভয়াবহ লুটপাট ও অপব্যবস্থাপনার খাত হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের অপকর্মে দেশের ডিজিটাল ইকোনমি এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিও নাজুক হয়েছে। বেপরোয়া দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে গণভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্তির পরে এই খাতের অপখরচ ও মেগা দুর্নীতি থামানোর জন্য যথাযথ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এমন তদন্ত যাতে অতীতের মতো ফাইলবন্দি হয়ে না থাকে; বরং আগামী ১০০ দিনের কার্যক্রমে সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছি। দুর্নীতি নয় বরং তথ্যপ্রযুক্তি খাত এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনকে বৈষম্যহীন উন্নয়নের সোপান হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, এই খাতে নেয়া প্রকল্পগুলোতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খোঁজ মিলেছে। ডুপ্লিকেশন, ট্রিপলিকেশন হয়েছে। একটা কাজ হয়তো হয়ে গেছে আবার এ কাজটি করা হয়েছে। ৫ টাকায় যে কাজ করা যেত, সেটি ওই প্রকল্পেই ২০ টাকায় করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও কাজই হয়নি। আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো কেটে দিচ্ছি।
যেসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি: মোবাইল গেইম ও এ্যাপ্লিকেশন এর দক্ষতা উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্প, দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে (১ম সংশোধিত), এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১১টি) (১ম সংশোধিত প্রকল্প, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১৪টি) প্রকল্প, হাই টেক সিটি-২ এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্প (১২টি জেলায়) (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্রনটিয়ার টেকনোলজি, শিবচর মাদারীপুরে প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, এস্টাবলিস্টমেন্ট অব বাংলাদেশ-ভারত সার্ভিস অ্যান্ড অ্যামপ্লয়মেন্ট ট্রেইনিং প্রকল্প, ডিজিটাল সরকার ও অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ (ইডিজিই) প্রকল্প, টেলিযোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত এলাকাসমূহে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপন (কানেক্টেড বাংলাদেশ) প্রকল্প, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, বিজিডি-ই-গভ সার্ট এর সক্ষমতা বৃদ্ধি (১ম সংশোধিত প্রকল্প), সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্লাটফর্ম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ডিজিটাল সিলেট সিটি, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (২য় পর্যায়) ও হার পাওয়ার প্রকল্প প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত)।
অনিয়ম ও অসঙ্গতি: প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু অঙ্গ ও কার্যক্রম প্রকল্পের উদ্দশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অপ্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসকল অপ্রয়োজনীয় অংশ প্রকল্প হতে বাদ দিলে সরকারের ৬ হাজার ৯৮১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হতে পারে। এমন অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে যা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। এ ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন ও অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ করায় জমি কেনা বাবদ অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশস্ত, অতিরিক্ত উচ্চ ও অতিরিক্ত অবকাঠামো যেমন আইটি ট্রেনিং সেন্টারে গুদাম নির্মাণ করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের অপচয় করা হয়েছে।
সকল অধিদপ্তর ও সংস্থা হতে একই প্রকার কাজ যথা ট্রেনিং সেন্টার, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে। যেখানে বিসিসি, অধিদপ্তর ও হাইটেক পার্কের কর্ম বিভাজন ছিল না এবং সকলে একই প্রকার কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ যে সকল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করেছে হয়েছে তা পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক ও সহায়ক জনবলের প্রস্তাব রাখা হয়নি। ফলে এসকল ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনার সুনিদিষ্ট রুপরেখা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ক্ষেএে তিনটি ফেজ এ ৪৭টি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণের কার্যক্রম একসঙ্গে না নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের সেন্টার নির্মাণ করে তার সাফল্য পাওয়া গেলে একইরকম প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে অন্যান্য স্থানে সম্প্রসারিত করা ঠিক হতো।
নারীর ক্ষমতায়ন ও অনুদান প্রদানের ক্ষেএে সুবিধাভোগী নির্বাচন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় করা হয়নি।
বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি না করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করা উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত শৃংখলার পরিপস্থী। বৈদেশিক সাহায্য না পাওয়া গেলে উক্ত অর্থ কীভাবে সংগ্রহ করা হবে তা নির্দিষ্ট নেই। এতে জিওবি অংশের খরচ করার পর অবশিষ্ট বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হবে। কিছু প্রকল্পের অধীনে ল্যাব, অ্যাপ , প্লাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যা ব্যবহার হচ্ছে না।
যা সুপারিশ:
১. বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা করে কমিটি হতে চিহ্নিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম প্রকল্পের স্কোপ থেকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া।
২. প্রকল্পে সৃষ্ট সুবিধা স্থায়ীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রকল্পের বাস্তবায়ন সমাপ্ত হওয়ার আগে নেয়া ।
৩. বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের এখতিয়ারের আওতা সুনিদিষ্ট করা।
৪. অডিট আপত্তিগুলো জরুরিভিত্তিতে প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে নিষ্পত্তি করা ।
৫. বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি সম্পাদিত না হলে সহয়তার আওতায় প্রাক্কলিত কাজগুলো প্রকল্পের স্কোপ হতে বাদ দেয়া।
সুত্রঃ টেকশহর।
আজ ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | শীতকাল | ২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | দুপুর ১২:০৩ | বুধবার
ডিবিএন/এসই/ এমআরবি