কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
একসময় অনুভব করলাম কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ডাকছে, মায়া, মায়া এই মায়া, চোখটা খোলো ময়না, আত্মারে আত্মা চোখটা খোলো, একটা বার চোখ মেলে দেখো আমি কতোটা অনুতপ্ত, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, আমি নিজের অজান্তেই এমনটা করেছি, আর কখনো এমন করবো না, কথা দিচ্ছি, একটাবার চোখ টা খুলে আমাকে ক্ষমা করো, নইলে যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। মায়া, মায়া, এই মায়া, আমি চোখ টা খুলে তাকিয়ে দেখি অন্তর আমার মুখের উপর ঝুকে আছে, আর অসহায়ের মতো কাকুতি মিনতি করছে। আমি চোখ খুলতেই অন্তর দুহাত জড়িয়ে ধরে বলছে, মায়া, মায়া আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না। আমাকে মাফ করে দাও মায়া। আমি কিছু না বুঝে বলে ফেললাম ঠিক আছে। তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভাবছিলাম অন্তর কি মানুষ নাকি এ্যালিয়েন? তার কি কোন রাগ নেই! যদিও সে আমার উপর কোন দিন রাগ করেনি, এমনকি কখনো ধমকের সুরেও কখনো কথা বলেনি। আমার সামান্য মাথা ব্যথাহলেও সারারাত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিত আর সারারাত জেগে থাকতো। কখনো মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলেও আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘুমাতাম ততক্ষণ পর্যন্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।
সেদিনের পর আর কোন দিন আমার মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয় নি। আমি মনে মনে চাইতাম, আমাকে একবার যদি মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিতো। অন্তর সেটা যখন বুঝতে পারতো, তখন মৃদু হেসে বলতো, মায়া তুমি কিন্তু নিজের হাতে খাওয়া টা বেশ ভালোই শিখেছো, পুরোপুরি শিখলেই তোমার ছুটি। আমি আসলে এই ছুটি টা কি তা ঠিক বুঝতে পারতাম না। তারপর এভাবেই কেটে গেলো আরো একটি বছর।
আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুকে নিয়ে কখনো কোনদিন একটিবারের জন্যও কোন খারাপ কথা বলেনি। তবে আমাকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। আমার ভালো মন্দ নিয়ে বুঝিয়েছে। শুধু বলেছে মায়া ভালো মন্দ তুমি সবকিছুই বুঝো, আর নিজের ভালো টা যদি না বুঝো স্বয়ং খোদাও তোমাকে বুঝাতে পারবে না।
তবে একদিন মনে অনেক চাপা কষ্ট নিয়ে বলেছিলো, শুন মায়া হয়তো আমি একদিন থাকবো না, সেদিন যদি তুমি ভালো না থাকো তবে আমার সব কষ্টই বৃথা, আর যদি ভালো থাকো তো আমার জীবনকোন আফসোস থাকবে না। বরং নিজেকে ধন্য মনে করবো।
তারপর একদিন রাতে আমি বাসায় ফিরতে পারলাম না। যদিও মাঝে মধ্যেই গভীর রাতেও বাসায় ফিরেছি, কিন্তু সেদিন আমার বন্ধুটা আমাকে জোর করে বাসায় ফিরতে দেয়নি। সে বললো, কিছুক্ষণপর তো সকালই হবে একটু রেশ নিয়েই যাও। একরাত বাসায় না ফিরলে ক্ষতি কি?
আমিও বন্ধুর কথায় সায় দিয়ে বললাম, তাই তো কি আর এমন হবে একরাত বাসায় না ফিরলে। বাসায় ফিরে দেখি দরজা খোলা, সকাল হয়ে গেছে। আমি ঘরের ভিতরে ঢুকতেই দেখি অন্তর নাস্তা রেডি করছে। আমি বললাম, বাহ, অনেক কিছু নিয়ে নাস্তা করেছো দেখছি। দাও, খুব খিদে পেয়েছে।
অন্তর অন্যদিকে তাকিয়েই বলে উঠলো, না, নাস্তা তোমার জন্য না, আমি বললাম তবে কার জন্য? অন্তর বললো, এটা শুধু আমার জন্য। আমি বললাম, অন্তর তুমি কি বলছো একবার ভেবে দেখেছো? আমাকে তুমি খেতে নিষেধ করছো।
অন্তর এবার চিৎকার করে বলে উঠলো হাঁ ঠিকই বলছি, তোমার ছুটি হয়ে গেছে, সেই ছুটিটা তুমি নিজেই নিয়েছো মিনু।
আমি এই প্রথম অন্তরের মুখে আমার আসল নাম শুতে পেলাম। বিয়ের পর সে একবারো এ নামে ডাকেনি, তার পছন্দের নাম শুধুই মায়া বলেই ডাকতো। আমি অনেক রেগেমেগে বকাঝকা করলাম, যদিও অনেক বার বকাঝকা করেছি কোন দিন প্রতিউত্তর দেয় নি। কিন্তু সেদিন যেন আমাকে কোন কথা বলার সুযোগই দিতে চাইলো না। সরাসরি বলে দিলো এ বাসার ভাতের বরাত আজ থেকে শেষ তোমার। মানে তোমার ছুটি, চিরদিনের জন্য তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম।
আমি বললাম, অন্তর তোমার এতবড় সাহস তুমি আমাকে ভাতের খোটা দিচ্ছো? এবার বুঝতে পারছি তোমার ছুটির মানে কি।ঠিক আছে তুমি থাক তোমার ভাত নিয়ে, আমি তোমার ভাতের নিকুচি করি।
আমি সেই অবস্থাতেই বাসা থেকে বের হয়ে সোজা আমার বন্ধুব ফ্ল্যাটে চলে এলাম। বেশ কিছু দিন ভালোই কাটলো বন্ধুর সাথে।
হঠাৎ একদিন সন্ধায় আমাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে এলো একটা বাংলোয়। তারপর দিন কাজের কথা বলে বেড়িয়ে গেলো। রাত হয়ে গেলো অথচ তার ফেরার নাম নেই। আমার বন্ধুর কেয়ারটেকার এসে জানালো, কিছু গেস্ট এসেছে আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আমি কিছু না ভেবেই ভিতরে বসতে বললাম। তারা ভিতরে ঢুকেই আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলো।
আমি বললাম, আপনারা কারা? অসভ্যের মত কথা বলছেন। সে জানতে পারলে আপনাদের রক্ষে নেই। সাবধান। বাজে লোক গুলো বলতে লাগলো ভয় নেই সুন্দরী সে আর কোনদিন আসবে না। তোমার নাগর তোমাকে আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এতদিন তোমার পিছনে ইনভেস্ট করেছে, আজ তা সুদে আসলে মিটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এসো সুন্দরী এসো।
আমার উপর ঝাপিয়ে পরার চেষ্টা করলো। আমি সাবধান করে বললাম, দাড়ান আমি ওকে ফোন করছি, সাথে সাথে আমি ওকে ফোন করছিলাম। কিন্তু তার ফোন বন্ধ, আমি অনেক চেষ্টা করেও একদল হায়েনাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলাম না।
এভাবেই কেটে গেল ৩/৪ মাস। দিনরাত হায়েনার দল আমার শরীরের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। একটা দিনের জন্যও সূর্যের মুখ দেখিনি। একদিন হায়েনার দলের একজন বলছিলো শালির মাগিকে জংগলে ফেলে দিয়ে আয়। আর রেখে লাভ নাই, রাখলে বিপদ বাড়বে। কারণ ততদিনে আমার শরীরের মধ্যে আরেকজনের বসবাস শুরু হয়ে গেছে। আমার শরীরের মাংস ছিঁড়ে খেতে তারা আর মজা পাচ্ছে না, শরীর টা ভারি হয়ে পঁচে যাচ্ছে।
একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা কুড়ে ঘরে। আমার সাথে একজন বুড়ি মা বসে আছে, আমাকে ডেকে বলছে তুমি কে গো মা, এই জঙ্গলে কিভাবে এলে? আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কিছু দিন পর কিছু টা সুস্থ হলাম একদিন ভাবছিলাম কি করবো কোথায় যাব, বুড়ি মার বোঝা হয়ে আর কতদিন থাকবো। কারণ বুড়ি মা ভিক্ষে করে খায়।
হঠাৎ মনে পড়লো অন্তরের কথা। ঠিক করলাম ঢাকায় ফিরে যাবো। যে মানুষ টা কে এতো ঠকিয়েছি তবুও আমাকে বুকে আগলে রেখেছে, তার কাছেই ফিরে যাবো, সে আমাকে ফেলতে পারবে না। তাকে বলবো আমি তোমার সন্তানের মা, হাঁ তার ঘরে থাকতেই আমার পেটে তার সন্তান এসেছে। তাকে জানাইনি, কারণ আমি সন্তান নষ্ট করতে চাইছিলাম। কিন্তু সেই সুযোগই পেলাম না। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই দিন শেষ হয়ে গেলো। এবার তার কাছেই যাবো তার কাছে মাফ চাইবো, তার পা পরে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবো। একটু আশ্রয় চাইনি, তার সন্তানের কথা জেনে অন্তত আমাকে আশ্রয় দিবে। তার সন্তানের জন্য আমাকে একটা শেষ সুযোগ দিবেই দিবে। আমি তো তাকে চিনি, আমার চোখের পানি সে সইতে পারবে না। আমার জন্য জীবনের সব কিছু করেছে, আমাকে পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি ভালোবাসে।
বুড়ি মা আমাকে ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করে দিলো তার ভিক্ষার টাকা দিয়ে। আমি বাসার গেটে পৌঁছালাম। গেটে দারোয়ান চাচা আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। আমার সামনে এসে বললেন আহারে আমার মায়ের সোনার মত মুখ খানি কি মলিন কালো হয়ে গেছে। আমি বললাম, চাচা আমাকে একটু উপরে নিয়ে যাবেন, অন্তর কি বাসায় আছে?
অন্তরের নামটা মুখে আনার সাথে সাথে দারোয়ান চাচা অঝোরে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। আমি বললাম, চাচা অন্তরের কি হয়েছে? চাচা ঠাঁই দাড়িয়ে রইলেন পাথরের মত, ঠোঁট দুটা থরথর করে কাঁপছে, অনেক কিছু বলতে চাইছেন।
অবশেষে আমি ধৈর্য হাড়িয়ে ফেললাম। চাচাকে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম, কিছু বলছেন না কেন, অন্তরের কি হয়েছে?
তখন চাচা শুধু বললেন, মাগো সাহেব নাই । আমি বললাম নাই মানে কোথায় গেছে? আমাকে ঠিকানা দেন, আমি তার কাছে যাব। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই এসেছি, আমাকে বলেন সে কোথায় গেছে। বলেন চাচা আমি না আপনার মেয়ে মত, তার কাছে আমাকে নিয়ে চলেন। আজ আমি বড় অসহায়, সে ছাড়া আজ আমার আর কেউ নাই চাচা, বলেন সে কোথায় গেছে?
তারপর চাচা বললো মাগো আপনাকে সাহবের কাছে নিয়ে যাবার মত সামর্থ আমার নেই, কারোই নেই রে মা। সাহেব মরে গেছে।
আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চাচা কিভাবে হলো আমাকে খুলে বলুন। চাচা বললো, মাগো আপনি যেদিন সকালে রাগ করে সাহেবের বাসা থেকে চলে গেলেন, সেই দিন রাতে স্টোক করেছিলো দুইদিন পর হাসপাতালে মারা গেছে।
আমি আর মানতে পারলাম না, চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। জানলাম একদিন পর আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি দারোয়ান চাচার ঝুপড়ি ঘরে। আমার পাশে চাচা বসে আছে। আমি চোখ মেলে তাকানোর সাথে সাথে চাচাকে চাচি ডাক দিয়ে বললেন, এই যে শুনছেন তারাতাড়ি আসেন মা জননীর জ্ঞান ফিরছে।
তারপর আমি চলে যাবার পর কি ঘটেছিলো জানতে চাইলাম। চাচা বললেন, সেদিন সন্ধ্যায় সাহেব আমার কাছে এসে বললো, চাচা আমি আপনাকে অনেক বিশ্বাস করি, আপনার কাছে একটা আমানত রেখে যাবো আমার বিশ্বাস আপনি আমার আমানত রক্ষা করবেন। বলেই আমারে একটা এই চিঠির খাম আর এই ডাইরিটা দিয়ে বলছে, যদি মায়া কোন দিন আসে এই দুইটা জিনিস তাকে দিয়ে বলবেন, এটা আমার জীবন শেষ সম্বল। মায়া ছাড়া কাউকে এই আমানত দিবেন না। এটা আমার শেষ অনুরোধ।
তারপর চাচার কাছ থেকে আমার আমানত গ্রহন করলাম। তারপর কি ঘটেছে জানতে চাইলাম।
চাচা বললো, আনুমানিক রাত দুইটা বাজে আমি একটা শব্দ শুনতে পারলাম, মনে হলো আপনাদের ঘর থেকে শব্দ টা আসলো। আমি তাড়াতাড়ি আপনাদের বাসায় গেলাম। দেখি সাহেব মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে। বুকের উপর দুটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। দুরে পানির গ্লাস আর জগটা পড়ে আছে। সে পানি খাইতে চাইছিলো। খেতে পারেনি, আমি দৌড়ে কাছে দিয়ে বললাম সাহেব আপনার কি হইছে, দেখলাম জ্যোগের পানিতে মেঝে ভিজে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি আবার পানি নিয়ে এসে খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু একফোঁটা পানিও খেতে পারলো না। শেষ কথাটা শুধু বলেছিলো, চাচা আমার আমানতের খিয়ানত করবেন না। আমার মায়া যদি কোন দিন ফিরে আসে তাকে আপনার হেফাজতে রাখবেন। আর বলবেন আমাকে যেন মাফ করে দেয়, আমি আমার মায়ার উপর অনেক অন্যয় করেছি। মায়া তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।
তারপর সে নিস্তেজ হয়ে গেলো, আমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দুইদিন পর ডাঃ বললো আইসিইউ তে রেখেছি অনেক টাকা বিল হয়েছে, তাড়াতাড়ি বিল পরিশোধ করেন। আমরা আপনার বাসার সব জিনিস পত্র বিক্রি করে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করলাম। যদি টাকা পয়সা থাকতো তবে সাহেব কে বাচনো যেত রে মা, বাচনো যেত। টাকার অভাবে সাহেবের ঠিকমত চিকিৎসা হলো না। বিনা চিকিৎসায় সাহেব মারা গেলো। কি ভালো মানুষ আসিল রে মা, মানুষ না একটা ফেরেস্তা আছিলো।
আমার চোখে আর একফোঁটা পানিও এলো না। চাচা বললো, মাগো আপনি তাও এসেছেন, আপনার আমানত বুঝাইয়া দিলাম, আমি এখন মরেও শান্তি পাব রে মা। তারপর আমি চিঠির খামটা খুলতেই একটা চিরকুট বেড়িয়ে এলো, তাতে লেখা শুধু –
“মায়া আমার শেষ সম্বল টুকু তোমার জন্য রেখে গেলাম, যদি তোমার এতটুকুও কাজে লাগে, তাহলে আমাকে শেষ বারের মত ক্ষমা করে দিও, আমার ব্যর্থতা তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।”………………………………………………………………………………….. “অন্তর”
চলবে……………………………………………………