কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
ভোর বেলা যখন হাসপাতালে পৌছালাম, আমার ছোট বোন ছুটে এসে বললো, আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন? সেই ফেরেস্তার মত মহিলা টা এসেছিলেন।
আমি বললাম, কোন মহিলা টা? ছোটবোন বললো, আপনি তো সত্যিই একটা অকৃতজ্ঞ মানুষ। যে মানুষ টি আপনার স্ত্রী সন্তান কে নিজের রক্ত দিয়ে বাচিয়ে গেলো তাকেই ভুলে বসে আসেন।
আমি বললাম, সে কোথায়? ছোটবোন বললো, সে তো চলে গেছে। আমি বললাম, কিছু বলে গেছে? কোন ঠিকানা দিয়ে গেছে?
ছোটবোন অবাক হয়ে বললো, বলেন কি? আপনি তার ঠিকানা জানেন না, তাহলে তাকে কোথায় থেকে ধরে এনে বিপদ থেকে উদ্ধার হলেন।
আমি কথা বাড়ালাম না, শুধু বললাম কিছুই বলে যান নি তিনি? ছোটবোন একটা চিঠির খাম আর একটা ডাইরি আমার হাতে দিয়ে বললো এগুলো আপনাকে দিয়ে গেছে।
আমি চিঠির খাম আর ডাইরিটা নিয়ে একটা নির্জন যায়গায় বসে চিঠির খাম খুললাম। চিঠিটা হাতে নিয়েই বুঝতে পারলাম, লেখার সময় মিনু অনেক কেঁদেছে, কারণ চিঠিতে চোখের পানি স্পষ্ট বোঝা যায়, যায়গায় যায়গায় চিঠিটা এখন ভিজে আছে।
কোন সম্মোধন ছাড়াই শুরু করেছে মিনু, ক্ষমা চেয়েছে তিন বার, আমার নাম না লিখেই বলছে-
“যাকে পাগলের মত ভালোবাসতে তাকে অন্যের হাতে কেন তুলে দিয়েছিলে তা আমার বিয়ের পর সব জানতে আর বুঝতে পেরেছি। যদিও তোমার উপর আমার কোন রাগ বা ন্যূনতম অভিমান নেই। কারণ আমার নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে টা করেছিলাম। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসতে তা আমি স্কুলের সময় থেকেই বুঝতে পারতাম। আর কলেজের সময়টা তে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন তুমি অভাবের তাড়নায় বাড়ি ছেড়েছিলে। যে দিন আমার কাছে বিদায় নিতে এসেছো, তোমার চোখের পানি আমায় প্রমাণ দিয়েছিলো, আমাকে তুমি কতটা ভালোবাসতে। কিন্তু কখনো প্রকাশ করোনি। তুমি যখন আমাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলে, তখন থেকে আমিও তোমার অভাব হাড়েহাড়ে টের পেলাম। কারণ আমার সৎ মায়ের অত্যাচার সইতে পেরেছি যখন তুমি আমার পাশে থেকে আমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে নানা উপায়ে। যখন তুমি আমার কাছে থেকে অনেক দূরে চলে গেলে, তুমি আমার কতোবড় আপনজন ছিলে, সবই বুঝতে পেরেছি তোমাকে কাছে না পাওয়া তে। কত ভালো বন্ধু ছিলে।
তারপর তুমি হঠাৎ ঢাকা থেকে তোমার বড় ভাই কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হলে। আর আমাকে বিয়ে করতে বুঝালে, যে আমি যদি বিয়ে টা করি তবে আমার পড়াশোনা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই সৎ মায়ের অভাবের সংসারে আর বোঝা হয়ে থাকতে হবে না। তারপর আমি বিষয়টা নিয়ে অনেকবার ভাবলাম যে, তুমি যখন তোমার বড় ভাইয়ের এতো ভালো মানুষের সার্টিফিকেট দিচ্ছো, আবার ভালো চাকরি করে, আর বিয়ের পরেও পড়াশোনা করতে দিবে, তখন ঠিক করলাম বিয়ে টা করাই আমার জন্য মঙ্গল হবে। বলতে গেলে সৎ মায়ের অত্যাচার আর অভাবের কারণেই বাধ্য হলাম, বিয়ে করেই এই অভাব শব্দ টা কে ঝেটিয়ে বিদায় করবো। তারপর তো বিয়ের এক মাস পর তোমার বড় ভাই মানে আমার স্বামী অন্তর আমাকে তার ঢাকার বাসায় নিয়ে গেলো, সবকিছু মোটামুটি ঠিক ঠাক চলছিল। এর মধ্যে তুমিও আর তেমন যোগাযোগ করতে না। জানতাম আমাকে ভালোবেসেও আমার মঙ্গলের জন্য তোমার ভালোবাসার মানুষ কে তুমি তোমার বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছো। আর তোমার কারণে যেন আমাদের সংসারে কোন অশান্তি দেখা না দেয় তাই তুমি আমাদের থেকে একসময় সম্পূর্ণ আড়ালে চলে গেলে। আর আমি হারালাম আমার জীবনের পরম বন্ধু কে। তোমার মত বন্ধু যদি আমার পাশে সবসময়ই থাকতে তাহলে আজ আমাকে তোমার এই অবস্থায় রাস্তায় দেখতে হতো না। এ দায় তোমাকে তো কিছু টা নিতেই হবে।
যাইহোক এবার আসল কথায় আসি, এক বছর পর আমি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ভাবলাম, জীবন থেকে তো অভাব দূর করেছি, এবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে পড়াশোনা বেশি মনোযোগ দিতে হবে। সুতরাং আমি পড়াশোনায় প্রচুর মনোযোগ দিতে লাগলাম। প্রথম সেমিস্টারে খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। তারপর অনেকের কাছে দাম পেতে লাগলাম। ততদিনে বেশ কিছু বন্ধু জুটে গেলো। একটা ছেলে বন্ধুর সাথে বেশ ভালো বন্ধু্ত্ব জমে গেলো। তার সাথে মাঝে মাঝে বাইরে ঘুরতে লাগলাম। ছেলে টা অনেক বড়লোকের ছেলে প্রচুর টাকা পয়সা। নিজের গাড়ি আছে।
একদিন তোমার বড় ভাই মানে অন্তর আমাদের দু’জন কে দেখে ফেলে ঢাকার বাইরে। আসলে আমরা লংড্রাইভে মাঝে মধ্যে যেতাম। অন্য দিনের মত সেদিনও গিয়েছিলাম, আর সেদিনই অন্তর তার অফিসের কাজে সেখানে ছিলো। মানে সেই খানে অন্তরের অফিসের নতুন প্রজেক্ট ছিলো। আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়। তখন আমার বন্ধুর সঙ্গে আমি কিছু টা অন্তরঙ্গ ভাবেই ছিলাম। তখন অন্তর আমাকে একটা কথাও বলেনি, এমন কি বেশ কিছুক্ষণ কাছাকাছি থাকার পরও অন্তর আমাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে গেলো।
তারপর বাসায় ফিরতে বেশ রাতই হলো, অনেক ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরলাম। একবার ভাবছিলাম বাসায় আর ফিরবো না, কোন মুখে আমি অন্তরের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। যে মানুষ টা আমাকে এতোটা বিশ্বাস করে, আমার ন্যূনতম অভাব রাখেনি, আমার কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি, আমি তাকে দিনের পর দিন ঠকিয়েছি। কি বলবো তাকে? সত্যি বলতে আমার কাছে কোন জবাব ছিলো না। তবুও সাহস করে তার সামনে দাঁড়াবো যা হবার হবে।
তারপর বাসায় ঢুকতেই দেখি দরজাটা খোলা ভিতরে অন্ধকার। আমি পা টিপতে টিপতে ভিতরে প্রবেশ করলাম, একবার ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। যাকগে ঘুমালে ভালোই হবে অন্তত এখনকার মত অন্তরের সামনে পরতে হবে না। তারপর কাল যা হবার হবে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। অন্তর বললো, এসেছো তাহলে। আমি ভেবেছিলাম আর ফিরবে না, ঠিক আছে ফিরেছো যখন হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও। নাকি খিদে নেই? অনেক কিছু খেয়ে এসেছো বলে আর খেতে চাও না? পেট টা ভরাই আছে? সে আর কিছুই বললো না। সোজা ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, কাকে দেখছি, সে কি আমার স্বামী নাকি অন্য কেউ ৷ তার বউ অন্যের সাথে সারাদিন কাটিয়ে মধ্যে রাতে ফিরে এসেছে আর সে কিছুই বলছে না, দিব্যি কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লো। আমি সারারাত একটুকুও ঘুমাতে পারলাম না, এপাশ ওপাশ করে ভোর হয়ে গেল। শরীরের ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল ১১ টা বাজে। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি টেবিলে নাস্তা সাজানো আছে। বুঝতে পারলাম, অন্তর নাস্তা তৈরি করে রেখে গেছে। এর আগে অনেকবার নাস্তা তৈরি করে রেখে যেত, এমনকি মাঝে মধ্যে সবকিছুই রান্না করত। আর ছুটির দিনে তো সবসময়ই রান্নাতে আমাকে সাহায্য করতো। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে এসে দেখতাম অন্তর অফিস থেকে এসে রান্না করে রাখতো। আমি আসলে তবেই আমার সাথে এক সাথে খেত। এমন কোন দিন জানা নাই যে সে আমাকে রেখে একলা খেয়েছে।
আমি নাস্তা খেতে বসলাম ঠিকই কিন্তু নাস্তা আমার গলা দিয়ে আর নামছে না। আমি সারাদিন কিছুই খেতে পারলাম না, রাত হয়ে গেল অনেক, কিন্তু অন্তর বাসায় ফিরলো না। একবার ভাবলাম রাতে বাসায় ফিরে না, এমন তো হয়নি, আবার কোন সমস্যা হয়নি তো? আবার ভাবলাম বাসায় আসেনি ভালোই হয়েছে।
পরের দিন বিকাল গড়িয়ে যাবার পর অন্তর খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলো। এসেই বললো তোমার মুখটা এতো শুকনা কেন কিছু খাওনি? খাবার নিয়ে এসেছি। এসো আমার সাথে খাবে, আমারো খুব খিদে পেয়েছে। আমি লক্ষ করে দেখলাম অন্তরের মুখটা সত্যি শুকনো কিছু খায়নি বেচারা। অনেকবার দেখেছি অফিসে ভালো খাবার দিলে সে কখনো খায়নি, সবসময়ই খাবার নিয়ে বাসায় আসতো আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো, তারপর নিজে খেতো। তবে আমি কখনো তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেইনি, আমার কখনো ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু আজ আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে না দিয়ে নিজেই খেতে শুরু করলো। আমি চুপচাপ বসে আছি। খাব নাকি খাবনা? বুঝতে পারছি না। হঠাৎ অন্তর আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, খাচ্ছো না কেন? খাও, আরে খাও খাও। জীবনের সবকিছু তো একলা করতে শিখে গেছো, শুধু একটা জিনিস করতে শেখো নি। খাওয়া টা তো সামান্য ব্যাপার, এটাও পারবে। চেষ্টা করো, পারবে। খাও, খাও। আর এটা করতে পারলেই তো তোমার ছুটি, বলেই একটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। যেন আকাশ পাতাল ভেঙে চৌচির হয়ে ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আমি আর নিতে পারছিলাম না। এটা কাকে দেখছি এটা কি অন্তর? নাকি ভয়ংকর হিংস্র দানব। আমি একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলাম।
চলবে……………………………………………………