২০১২ সালের ১৪ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ইসলামপুরে খুন হয় পাঁচ মাসের শিশু ইভা। এ ঘটনায় ইভার বাবা নিজাম মিয়া বাদী হয়ে কুলাউড়া থানায় সাত’জনের নাম উল্লেখ করে এদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও জেলা ডিবি এজাহারনামীয় ব্যক্তিদেরই অভিযুক্ত করে। ২০১৬ সালে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় মৌলভীবাজার জেলা পিবিআই। সংস্থার পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলামের তদন্তে উঠে আসে- জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশুটিকে হত্যা করে তারই বাবা, মা, দাদি ও দুই চাচা। দুই চাচা আবুল হোসেন ও রাশেদ আলী হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন।
গত বৃহস্পতিবার (৪ মে) কুলাউড়ার এ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও উল্লেখ করা হয়, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাক, বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. আরিফুল ইসলামকে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবির এক নদীর পাশে খুন করে লাশ গুম করা হয় টাঙ্গাইলের কালিহাতীর পারুল আক্তারকে। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ডোবার পানি থেকে লাশ উদ্ধার করা হয় মো. স্বপন মিয়ার। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে এসব খুনের কিনারা হয়েছে। এ চারটি ঘটনায় খুনের সঙ্গে জড়িতরা মা-বাবা, চাচা ও ভাই। অথচ তারাই মামলার বাদী।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট যখন এসব হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা করতে পারছিল না তখন দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে। মামলার অভিযোগপত্র ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগের একটি হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে প্রতিবন্ধী আরিফুলকে হত্যা করে তারই বাবা ও চাচা। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশু ইভাকে হত্যা করে তারই বাবা, মা ও চাচারা। পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করায় পারুল আক্তারকে হত্যা করে লাশ গুম করে তার বাবা আবদুল কুদ্দুছ খাঁ। আর পারিবারিক সম্পত্তির বিরোধের জের ধরে স্বপনকে হত্যা করে লাশ ডোবায় ফেলে দেয় তারই আপন ছোট ভাই রিপন মিয়া।
পিবিআই সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি এমন অন্তত আটটি হত্যা মামলার তদন্তের পর বাদীকেই আসামি করতে হয়েছে। অনেক হত্যা মামলায় বাদী জড়িত থাকলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের অভাবে ক্লুলেস অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে মিথ্যা অভিযোগে করা ওইসব মামলার বোঝা বছরের পর বছর বইছেন অনেক নিরপরাধ মানুষ। এসব মামলার বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই থানা পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) দেওয়া প্রতিবেদনে নারাজি দিয়েছে বাদী।
জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘বাদী আসামি হওয়ার ঘটনা মূলত হত্যা মামলা ক্ষেত্রে ঘটে। এ মামলাগুলো আসলেই কঠিন। আমাদের নিজেদের কাছেও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু করার থাকে না। পরিবারের লোক প্রিয়জনকে হারাল, সেই পরিবারের লোককেই আবার সন্দেহ করা হচ্ছে। সুতরাং এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর বাদীকে গ্রেপ্তার করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বহু জায়গায় এমন মামলা আছে। আমরা যে মামলাগুলোতে বেশি সময় দিতে পারি না সেই মামলা ক্লুলেসই থেকে যায়। বাদীকে সন্দেহ করা হলেও প্রমাণের মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে না। মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে এ ধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে।’
যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলো সে ঘটনার মামলার অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, শ্রীমঙ্গলের হাজীপুরে ২০১৭ সালের ২৪ জুন খুন করা হয় প্রতিবন্ধী আরিফুল ইসলামকে (১৮)। এ ঘটনায় তার বাবা মো. আরবেশ আলী বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে শ্রীমঙ্গল থানায় হত্যা মামলা করেন।
“ডিজিটাল বাংলা নিউজ” অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তার স্ত্রী পুকুরে থালাবাসন ধুতে গেলে প্রতিবেশী খালেকের স্ত্রী রওশানারা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এর জের ধরে খালেক ও অন্য আসামিরা রামদা, লোহার রড নিয়ে আরবেশ আলীর বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তার ছেলে আরিফুলকে কুপিয়ে জখম করে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত শেষে এজাহারভুক্ত ১৮ আসামির মধ্যে তিনজনকে অব্যাহতি দিয়ে বাকিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই মৌলভীবাজার জেলা ইউনিট।
পিবিআইয়ের তদন্তে পাল্টে যায় মামলার দৃশ্যপট। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ঠান্ডা মাথায় আরিফুলকে হত্যা করে মামলাটি করা হয়েছে এমন তথ্য উঠে আসে তদন্তে। বাদীপক্ষের তিনজন হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে।
জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পূর্বশত্রুতার জের ধরে বিবাদীদের ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে আরিফুলের আপন চাচা ইয়াকুবের পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। উভয়পক্ষের ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ির একপর্যায়ে ইয়াকুব বাঁশের লাঠি দিয়ে আরিফুলের মাথায় আঘাত করেন। এ ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর অটোরিক্সায় করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাকে মাথায় কুপিয়ে, পায়ের রগ কেটে ও গলা টিপে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইয়াকুব ছাড়াও হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় বেলাল, জুনায়েদ, তোফায়েল ও সামছুল। মামলাটি এখনো আদালতে বিচারাধীন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই মৌলভীবাজার জেলার তৎকালীন পরিদর্শক মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আরিফুলের চাচার পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় আর এ বিষয়টি আরিফুলের বাবা আরবেশ আলী জানতেন। মূলত এ হত্যাকাণ্ডের আগে ওই এলাকার বাজারে আরও একটি হত্যাকাণ্ড হয়। আরবেশ আলী সেই হত্যা মামলার ১২ নম্বর আসামি। মামলা থেকে বাঁচার জন্য মীমাংসার অনেক চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন তিনি। আরবেশ মনে করেছেন মীমাংসার জন্য আরেকটি লাশ দরকার। তখন প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে হত্যা করে তারা।’
২০১৫ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় স্বামীর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন টাঙ্গাইল কালিহাতীর আবদুল কুদ্দুছ খাঁর মেয়ে পারুল আক্তার। পারুলের স্বামী ও স্বজনদের আসামি করে টাঙ্গাইলে একের পর এক মামলা করেন আবদুল কুদ্দুছ খাঁ। ওইসব মামলায় জেলও খেটেছেন পারুলের স্বামী নাসির উদ্দিন বাবু। কিন্তু টাঙ্গাইল ডিবি ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করেও পারুলের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। সবশেষে আদালত জুডিশিয়াল তদন্ত করে রিপোর্ট দেয় যে, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারে।
গত বছর ২৭ নভেম্বর কুদ্দুছ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যৌতুকের জন্য মারধর করে হত্যা মামলার আবেদন করেন। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা নথিভুক্ত করতে বলে এবং পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। গত বছর ১১ ডিসেম্বর মামলা হওয়ার পর পিবিআই তদন্ত শুরু করে।
সংস্থাটির তদন্তে উঠে আসে পারুল তার বাবার হাতেই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। একটি মোবাইল ফোন নম্বরের দুটি ডিজিট ‘৩৭’-এর সূত্র ধরে সাত বছর পর নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন করে পিবিআই।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘আবদুল কুদ্দুছ ও তার বন্ধু মোকা মন্ডল হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।’ তিনি আরও জানান, পরিবারের অসম্মতিতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে নাসিরকে বিয়ে করেন পারুল। এতে সামাজিকভাবে অপদস্থ হন পারুলের বাবা। সেই ক্ষোভ থেকে পারুলকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে একটি নদীর পাশে নিয়ে কুদ্দুছ ও তার বন্ধু হত্যা করেন। একই ক্ষোভে পারুলের স্বামী নাসিরকে ফাঁসাতে মামলা করেন তিনি।
২০২১ সালের ২৮ জুলাই কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি ডোবা থেকে মো. স্বপন মিয়ার লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় পরদিন তার ছোট ভাই মো. রিপন মিয়া ভৈরব থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামিকে করে হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই কিশোরগঞ্জ জেলা। তদন্তের একপর্যায়ে জানা যায়, স্বপনের খুনি আর কেউ নয়, তারই ছোট ভাই রিপন। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে অপরাধ স্বীকারও করেন তিনি। রিপন বলেছেন, পারিবারিক জমির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জেরে স্বপনকে হত্যা করেছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে হত্যা করা হয় তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে। চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুলের সম্পৃক্ততার প্রমাণ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। মিতু হত্যা মামলারও বাদী ছিলেন বাবুল আক্তার।
তদন্ত পর্যায়ে বাদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলছে এমন কিছু মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যদি কোনোভাবে লিংক পাওয়া যায় যে বাদীর দ্বারাই হত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাহলে ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর হয়ে যায়। বাদী যদি অপরাধের দায় আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে স্বীকার না করে তাহলে প্রমাণ করা যায় না। এ ছাড়া বাদী নিজে অপরাধী এমন মামলায় আইনি কিছু জটিলতাও আছে। বাদী যেহেতু মামলা করে সেহেতু তার অনেক আইনি ক্ষমতা থাকে, সে বেশ কিছু সুবিধাও পায়। বাদী ওই মামলা নিয়ে খেলতেও পারে। তখন বাদীর মামলাটি অন্যভাবে নিষ্পত্তি করে, ফের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন করে মামলা করার নজিরও রয়েছে।
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজ বাপ্পি