সাকিব আল হাসান: বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে পুরনো ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজ। সিলেটের ‘অক্সফোর্ড’ খ্যাত এই বিদ্যাপীঠটি হয়ে উঠেছে যেনো মন্ত্রী বানানোর কারিগর। দেশের বাঘা বাঘা সাবেক ও বর্তমান অনেক মন্ত্রীই এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি দেশে প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর মধ্যে ৭ম। পুরনো এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য। কতো শত রথীমহারথীরা শিক্ষাজীবনে এই কলেজ থেকেই শিক্ষা লাভ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে। দেশ স্বাধীনের পূর্ববর্তী সময়ে তো বটেই, পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশেরও অনেক সংসদ সদস্যরাও এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। শুধু সংসদ সদস্যই নয়, এদের অনেকেই স্থান করে নিয়েছেন মন্ত্রীসভাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ থেকে শুরু করে দেশের দুই সফল অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.একে আব্দুল মোমেন এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।
আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২৬ সালের ১৫ জানুয়ারী সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়, ভুরাখালী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়ে সামাদ আজাদ ১৯৪৮ সনে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন৷ সাবেক এ মুরারিয়ান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। তিনি প্রাক্তন এমপি, বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৫ম সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী ১৯৭৯ সালে গঠিত জিয়াউর রহমান মন্ত্রীসভার যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার শিক্ষাজীবন গ্রামের রাজাগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়। এরপর তিনি সিলেট রসময় উচ্চ বিদ্যালয় ও সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে সিলেট ঐতিহ্যবাহী সরকারী মুরারিচাঁদ কলেজে লেখাপড়া করেন।
বাংলাদেশের সবচাইতে সফল সাবেক অর্থমন্ত্রীরদের মধ্যে দুজন হলেন এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আব্দুল মুহিত। সর্বোচ্চ ১২বার করে সংসদে জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন দুজনেই।
সাইফুর রহমান ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে দি এইডেড হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫১ সালে এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৮০-৮১, ১৯৯১-১৯৯৫ এবং ২০০২-২০০৬ সালে দীর্ঘ মন্ত্রীজীবনে ডিসেম্বর, ১৯৭৬ থেকে অক্টোবর, ২০০৬ পর্যন্ত তিনটি সরকারের আমলে ১২টি জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন।
আবুল মাল আব্দুল মুহিতও ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮২-১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন মুহিত। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে সিলেট-১ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রী হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করেন। সাবেক এই মুরারিয়ানও সর্বোচ্চ ১২বার করে সংসদে জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া সত্তরের নির্বাচনেও তিনি প্রদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১২ সালে দ্বিতীয় রেল মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। জাদরেল এই পার্লামেন্টারিয়ানও ছিলেন সাবেক মুরারিয়ান। শিক্ষাজীবনে তিনি এমসি কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। সংসদে সব সময় সরব এ সংসদ সদস্য একজন অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা (সিলেট-৬) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদের সফল শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সিলেটের গুণী এই ব্যক্তিও তার শিক্ষাজীবনের উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়েছেন এই এমসি কলেজ থেকেই।
জাতীয় একাদশ সংসদ নির্বাচন শেষে গত সোমবার বিকেলে গঠিত হয় এবারের নতুন মন্ত্রীসভা। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট নতুন এই মন্ত্রী সভায় স্থান পাওয়া মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। এসব মন্ত্রীর মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি, প্রতিতাযশা কূটনৈতিক ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে। মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারটি দখল করে নেওয়া ড. মোমেনও সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের সাবেক ছাত্র ছিলেন।
শুধু মন্ত্রীত্বের দিক থেকে নয়, দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে রয়েছে সাবেক মুরারিয়ানদের জয়জয়কার। শুধু দেশে মুরারিয়ানদের গণ্ডি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে বিদেশেও। আজকের মুরারিয়ানদের মধ্যে কেউ হয়তো আগামীতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে এমনটিই মনে করেন সাবেক এবং বর্তমান মুরারীয়ানরা।