মধুর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
প্রাচীন কাল থেকেই মধুর ব্যবহার প্রচলিত ছিল আমাদের দেশে। তবে শুধু যে দেশেই এটি প্রচলিত তাই নয়, বিদেশেও কিন্তু এর কদর প্রচুর। তাই মধুর উপকারিতা এর কথা বলে কখনও শেষ করা যাবে না। চীন-সহ এশিয়ার আরও অনেক দেশই সেখানকার অধিবাসীরা তাদের সকাল শুরু করে মধুর হাত ধরে। অর্থাৎ তাদের প্রাতরাশ শুরুর পর খাবারের তালিকায় প্রথম শুরুতে থাকে মধু।
লোকে বলে, জন্মের পর শিশুর মুখে প্রথম মধু দিলে সে সবসময় মিষ্টি করে কথা বলবে সবার সাথে। এটা অবশ্য সত্যি কথা নয়, কথার কথা। কিন্তু মধুর যে প্রাকৃতিক বিশেষ গুণাবলী আছে, সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মিষ্টি কথা বলতে পারার গুণ অর্জন যদিও সম্ভব নয় কিন্তু শরীরের ক্ষেত্রে রয়েছে এর বিশেষ গুণ। মধুর সুফল বা উপকারিতা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে রূপচর্চা ও চুলের যত্নে। আজকের পর্বে আমরা জানতে পারব মধু সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আমরা অনেককেই দেখেছি, গরম জলের সঙ্গে মধু, চায়ের সঙ্গে মধু ইত্যাদি নিয়মে প্রতিদিন নিয়মিত মধু খেয়ে থাকেন। তার উপকারিতা বা সুফলও কিন্তু তারা পান পুরোদমে।
চলুন, জেনে নেই, সেই সুফলগুলি কী কী? মৌমাছি দ্বারা সংগৃহীত প্রাকৃতিক এই মধু থেকে তৈরি মানুষের খাদ্য এই মধুতে রয়েছে দারুণ খাদ্যগুণ। এবার দেখে নেওয়া যাক মধু নিয়মিত খেলে কী কী উপকারিতা লাভ করা যায়?
মধুর উপকারিতা
১। রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়াতে মধুর উপকারিতা– মধুর যে উপকারের কথাটি এখন বলব তা হল মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি আপনার শরীরকে নানা রকম ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে প্রতিরোধ করে। আর মধু আপনার শরীরে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দ্বারা রোগ প্রতিরোধকারী শক্তি গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন ভয়ানক সংক্রমণ থেকে আপনার দেহকে রক্ষা করে।
২। ওজন কমাতে মধুর উপকারিতা– নিয়মিত মধু খেলে পাকস্থলীতে বাড়তি গ্লুকোজ তৈরি হয়। এই গ্লুকোজ মস্তিষ্কের সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়। তার ফলে মেদ কমানোর হরমোন নিঃসরণের জন্য বেশি মাত্রায় চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মেদ কমে যায়।
৩। অনিদ্রায় মধুর উপকারিতা– অনিদ্রার থেকে মুক্তির জন্য খুব ভালো একটি পথ্য হল মধু। রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে প্রতিদিন মধু খেলে গভীর ঘুম হয়।
৪। কোষ্ঠকাঠিন্যে সমস্যায় মধুর উপকারিতা– প্রাকৃতিক এই মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। আর এই ভিটামিন বি কমপ্লেক্স কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে আপনাকে রাখবে সুস্থ।
৫। ডায়রিয়ায় মধুর উপকারিতা– মধু ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাই যাঁদের আমাশয়, ডায়রিয়া বা পেট খারাপের প্রবণতা আছে তাঁরা নিয়মিত মধু সেবন করতে পারেন।
৬। অম্বলের সমস্যায় মধুর উপকারিতা– প্রতিদিন ভোরবেলা যদি আপনি নিয়মিত খাঁটি মধু খান তা হলে তা আপনার অম্বলের সমস্যা থেকে মুক্তি দিবে এবং মুখের টক ভাবও দূর করবে।
৭। হজমের সমস্যায় মধুর উপকারিতা– মধুর মধ্যে থাকা উপাদানগুলি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে খাবার খাওয়ার পর বদ হজম, গলা বুক জ্বালা ইত্যাদি সমস্যা দূর হয়।
৮। পাকস্থলীর সুস্থতায় মধুর উপকারিতা– মধু খেলে পাকস্থলীর কাজ জোরালো হয়। কারণ এটি হজমে সাহায্য করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক অ্যসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয়। তার ফলে পাকস্থলীর কাজ ভালো হয়।
৯। অরুচিতে মধুর উপকারিতা– অনেকেই বেশি খেতে পারেন না। একটু খেয়েই হাঁপিয়ে ওঠেন। বা খাবারে ইচ্ছাটাই থাকে না। অরুচিতে ভোগেন। সে ক্ষেত্রে মধু খেলে খাবরে অরুচি কমে। খাবার চাহিদা বাড়ে।
১০। রক্ত উৎপাদনে মধুর উপকারিতা– রক্ত উৎপাদনকারী উপকরণ হল আয়রন। আর এই আয়রন প্রচুর পরিমাণে রয়েছে মধুতে। ফলে শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা-সহ রক্তের ইত্যাদি উপাদানগুলি গড়ে তুলতে সাহায্য করে মধু।
১১। কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে মধুর উপকারিতা– মধু রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ ১০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমার অর্থ হল হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যাওয়া।
১২। পেশিশক্তি বাড়াতে মধুর উপকারিতা– পেশিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে মধু। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি। এই প্রাকৃতিক চিনি শরীরে শক্তি যোগায়। পেশিকে অনেক বেশি কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে।
১৩। গলার স্বর যন্ত্রের জন্য মধুর উপকারিতা– গলার স্বর যন্ত্রে বা স্বরনালীতে সংক্রমণ হলেও সেই ক্ষত দূর করতে নিয়ম মাফিক মধু সেবন করা যেতে পারে। তা ক্ষত নিরাময় করে। সংক্রমণ দূর করে।
১৪। তারুণ্য ধরে রাখতে মধুর উপকারিতা– মধু এমন একটি উপাদান যাতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বল রং, টানটান ভাব ধরে রাখে। ফলে রিঙ্কেল পড়ে না। মধু তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
১৫।চুলের স্বাস্থ্যে ও রূপচর্চায় মধুর উপকারিতা– ত্বক টানটান চকচকে করতে মধু একটি বিশেষ উপকারী উপাদান হিসাবে বিবেচ্য হয়। শুধু ত্বক নয়। সৌন্দর্য বিদ্যায় চুলের বিশেষ যত্নেও মধুর উপকারিতার কথা বলা হয়। চুলের যত্নে মধুর অবদান অনস্বীকার্য এবং আদি যুগ থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে তা।
গরান ফুলের মধুর উপকারিতা
দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত মধুর শতকরা ২০ ভাগ মধু সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা হয়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের একটি মধু হল গরান ফুলের মধু । মানের দিক থেকেও গরান ফুলের মধুর উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
মধু সংগ্রহের জন্য প্রতিবছরের এপ্রিল মাস থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় অবধি বন বিভাগ মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের অনুমতিপত্র (পাস) দেয়। আর তখন থেকেই মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌয়ালরা। পরিচ্ছন্নভাবে মধু সংগ্রহ এবং এর গুণগত মানও বজায় রাখার জন্য বেসরকারি সংগঠনগুলো মৌয়ালদের বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি বিতরণ করে থাকে।
ঠান্ডায় মধুর উপকারিতা
যাদের ঠাণ্ডার সমস্যা আছে তারা প্রতিদিন যদি নিয়মিত মধু খান তাহলে আপনার অতিরিক্ত ঠান্ডা লাগার প্রবণতা দূর হয়ে যাবে। এছাড়াও চা, কফি ও গরম দুধের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে হাঁচি, কাঁশি, জ্বর জ্বর ভাব, জ্বর, সর্দি জনিত সমস্যা, গলা ব্যথা, টনসিল ফুলে যাওয়া, জিহ্বার ঘা (ঠান্ডাজনিত) ভালো হয়ে যায়। সমপরিমাণ আদারস এবং মধুর মিশ্রণ কাশির সাহায্যে শ্লেষ্মা বের করে ফেলার একটি সহায়ক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এটি ঠান্ডা, কাশি, কণ্ঠনালির ক্ষত, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ দেয়।
কালোজিরার মধুর উপকারিতা
কালোজিরার ভেষজ ব্যবহার
নিদ্রাহীনতায় : এক গ্লাস গরম দুধের সাথে এক চামচ কালোজিরা ও মধু মিশিয়ে ঘুমের পূর্বে নিয়মিত সেবন করতে হবে। এতে করে অনিদ্রা দূর হয়ে প্রচুর ঘুম হবে।
মাথা ব্যথায় : মাথা ব্যথার সমস্যায় পরিমাণ মতো করে কালোজিরার চূর্ণ এর সাথে তার অর্ধেক পরিমাণ গরম লবঙ্গ এবং অর্ধেক পরিমাণ মৌরিফল ভালভাবে মিশিয়ে মাথা ব্যথার সময় ননিযুক্ত দুধের সাথে সেবন করতে হবে। আর কালোজিরার তৈল থেকেও অনেক উপকার পাওয়া যায়।
যৌবন ধরে রাখতে ও লাবণ্যের জন্য : কোমল কালোজিরা পাতলা সিরকা এবং এক চামচ পরিমাণ গমের গুঁড়া মেশাতে হবে। এই মিশ্রণ সন্ধ্যা বেলায় মুখমণ্ডলে মালিশ করবে এবং সকালে গরম পানি ও সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবে। এক সপ্তাহ প্রতিদিন একাধিকবার তা করবে। আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে