“ভিলেজ ডক্টর” রচনা লিখেছি বহু, লিখতে হয়েছে পরীক্ষার খাতায়। রাত জেগে জেগে “ভিলেজ ডক্টর” রচনা মুখস্থ করেছি। মনে মনে অমন ডাক্তারই কল্পনা করেছি। গ্রামে বড় হয়েছি দেখেছি এমনই একজন ডাক্তার।নাম ছিল তার জলধর। শুনেছি তিনি নাকি আয়াডক্টর নন্দির এসিষ্টেন্ট ছিলেন। পরে নীজেই প্রেক্টিস শুরু করেন কাজীরপাগলা বাজারে। এল এম এফ ডাক্তার ছিলেন তিনি। চশমা পিরিহিত স্থুল দেহের জলধর ডাক্তার শ্রীনগর এবং লৌহজং দুই থানারই জনপ্রিয় চিকিতসক ছিলেন। কাজীরপাগলা স্কুলের কারনে বাজার জমেছিল কিন্তু, জলধরের ডাক্তারের কারনে বাজারটি জমজমাট হয়ে উঠেছিল। আরও একজন ডাক্তার বসতেন ঐ বাজারে, ডাঃ করিম। এম বি বি এস হয়েও ডাক্তার করিমের রোগীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। অথচ জলধর ডাক্তারের চেম্বারে বসার জায়গা হতনা। দিন নেই রাত নেই রোগীদের সংগেই ছিল তার জীবন। কাজিরপাগলা বাজারে একটা বড় টিনের ঘর ছিল তার চেম্বার। একপাশে একটি রুমে তিনজন কম্পাউন্ডার অবিরাম ঔষুধ দিচ্ছে আর ডাক্তারের সামনে টুলে বসে অপেক্ষা করত অনেক সব রোগী। কারো কারো ফিস দেওয়ারও ক্ষমতা নেই, চিকিৎসা না নিয়ে ফিরেনি কেউ। অন্য ঘরে মহিলারা সব।সমান ভাবেই ভিড় লেগে থাকত। প্যথলজির সব পরীক্ষা নিজেই করতেন। সন্ধার পরে চেম্বার বন্ধ হয়ে যেত, রোগী দেখতেন নিজ বাড়ীতেই তখন। কলে যেতেন প্রহরী নিয়ে রাতেও। দুর দুরান্ত থেকে লোকেরা আসত গভীর রাতে। কেউ ফিরে গেছে শোনা যায়নি। ডোবা অঞ্চল, বর্ষাকালে শত শত নৌকা এসে ভিড় করত কাজীরপাগলা বাজারের চার পাশে। চেম্বারের রোগী ছাড়াও নৌকায় যেতেন নিজেই। পরীক্ষা করে ফিরে আসতেন চেম্বারে। রাতের বেলা বড় ছইওয়ালা নৌকায় চড়ে গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুড়ে বেড়াতেন রোগীদের সেবা দিতে। বিছানা পাতা নৌকাতেই ঔষধপত্র ছাড়াও ছোটখাট অপারেশন সেরেছেন জলধর ডাক্তার। দুরের পথ হলে নৌকাতেই নিদ্রা সেরেছেন ঝড় বৃষ্ট তুফানেও। যাদের মনে আছে জিগ্যেস করলেই এমনই বলবে ডাঃ জলধরের কথা। শোনা কথা, ৬৫ সালে পাক-ভারত যূদ্ধের পর কারা যেন ভারতের গুপ্তচর বলে অপমান করেছিল, সেই ক্ষোভেই একদিন কাউকে না জানিয়ে ভারতে চলে গেছেন জলধর ডাক্তার। আর ফিরে আসেননি, সেখানেই নতুন করে প্রেক্টিস শুরু করেন। জলধর ডাক্তারের শিশিতে রংগীন মিক্সার সেবন করেই রোগ ভাল হয়ে যেত। গ্রাম্য ডাক্তার সবাই এমনই ছিলেন, শুধু জলধর নয় স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলে সকলেরই নিজ নিজ এলাকার গ্রাম্য ডাক্তারের চিত্রটি এমনই হবে। লাউ আর গরুর দুধের বিনিময়েও চিকিৎসা নিয়েছে, অর্থের জন্য রোগীকে ফিরিয়ে দেননি গ্রাম্য ডাক্তাররা। এখন বাংলাদেশের ডাক্তাররা টাকার জন্যই রোগী দেখে। অর্থ উপার্জনের লোভনীয় পেশা হলো ডাক্তারী। নগদ অর্থ না পেলে অপারেশন থিয়েটার থেকেও ডাক্তার সাহেব হাত ধুয়ে চলে যান। রোগী এলে পরীক্ষা না করেই লিখতে থাকেন। অর্ধেক লিখে মিনিটখানেক পরিক্ষা করে আবার লিখেন। ঔষুধ লিখেন তবে তা ফাইনালটা না। টেষ্ট দেন তিনটা (কম করে হলেও)। ভিজিট ১০০০ টাকা, তিনটি টেষ্টের বিল আরো দুই হাজার (কম হলেও)। টেষ্টের রেজাল্ট দেখাতে গিয়ে আবার দিতে হয় আরো ১০০০ টাকা। একবার ডাক্তার দেখালেই ৫০০০ টাকা গুনতে হয় রোগীকে। যে কারনে সাধারন মানূষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যেন ডাক্তারের কাছে যেতে না হয়। অপারগ হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ফতুর হয়, বলতে পারেন। এখন দেখছি টেষ্ট না করেই সুস্থ্যতার সার্টিফিকেট দেয় ডাক্তাররা। মরা মানূষকে পাম্প করে যন্ত্র চালিয়ে রেখেও লক্ষ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নেয়, দুস্থ্য করে দেয় অসহায় পরিবারকে। হাসপাতালে গেলেই ICU তে নিতে হয়, ঔষুধ না দিয়েই বিল করে ইচ্ছেমত। বিচার চাওয়ার জায়গাও নেই কারন, ডাক্তার! আমরা কৈশরে যে ” ভিলেজ ডাক্তার” রচনা পড়েছি আর লিখেছি, আজকের ডাক্তারদের সংগে তাদের কোন মিল নেই। এখন নিয়োগ পেলেও গ্রামে কোন ডাক্তার যেতে চায়না। মাসে দুইদিন উপিস্থিত হয়ে বেতন তুলে নেয়, নিয়মিত প্রেক্টিস করে শহরে। এখন নাকি চিকিৎসা খাতেই দুর্নীতি হয় সব চাইতে বেশী। তাহলে কি আবার নতুন করে ” ভিলেজ ডক্টর” রচনাটি শিক্ষাত্রীদের জন্য সিলেবাসে অন্তরভুক্ত করা উচিত?
আজিজুর রহমান প্রিন্স
রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক
টরেন্টো, কানাডা
১৩ জুলাই ২০২০।