ভাষার রঙে আমার চিহ্ন?
কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
“ভেতরটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে কেন জানি না,
তবুও কেউ জানে না, জানার চেষ্টাও করবে না জানি কখনো।
তবুও কেন যেন অপেক্ষায় থাকি,
সত্যি নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,কিন্তু করি না।”
বলছি ১৯৫২ সালের সেই উত্তাল দিন গুলোর কথা, আমি তখন শাহবাগ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সামান্য ফুল বিক্রেতা, জন্ম আর পরিবারের কথা নাই বললাম, যদি বলি তবে আমি সামান্য ফুল বিক্রেতা বললে কেউ মানতে চাইবেনা, তবে বাস্তবতা হলো সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাকে সৃষ্টি করতেই কিছুটা বৈষম্য করেছেন নিজের অজান্তেই।
মানুষ দুই প্রকার নারী বা পুরুষ, তবে আমি কোনটাই নই, তবে আমি কি? বিধাতা কি তা জানেন তোমাদের মানব সমাজে কি পরিচয় দিবে আমায়, সেটা একান্তই তোমাদের সমাজের ব্যাপার। যে কথাগুলো না বললেই নয়, আমি সবে মাত্র শৈশব থেকে কৈশোরে প্রবেশ করছি। ঝামেলা বাঁধলো সেখান থেকেই।
এতোদিন জেনে এসেছি আমার শরীর টা পুরুষ, মানে তোমরা আমাকে এটাই শিখিয়েছো, আমার পরিবার তোমাদের সমাজ সেটাই জানো। কিন্তু আমার ভেতর টা সব সময়ই একটা বিদ্রোহের সূর তুলতো, আসলে কেন বিদ্রোহ করতো তার কোন কূলকিনারা খুজে পেতাম না, কিন্তু আমার কৈশোরে এসে সত্যি সত্যি বিদ্রোহটা কিসের ছিলো তা পরিষ্কার করে দিলো তোমাদের সমাজ, আর আমার আশেপাশের সব বন্ধু গুলো, যাদের সাথে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছি। আর আমিও আমার মনের বিদ্রোহ বুঝতে পারলাম, আমার শরীর পুরুষের কিন্তু আমার আত্মা, সমস্ত অনুভূতির অস্তিত্ব জুড়ে এক নারী সর্বাধিকারী। আমার মন আমার শরীরকে পরিচালিত করে, সত্ত্বা আমার নারী অথচ পরিবার আর এই সমাজ আমার শরীর পুরুষ বলে চাপিয়ে দেয়। আমাকে কেন বাধ্য করে, বিধাতা তুমি কোথায়।
যতই দিন যেতে থাকলো ততই আশেপাশের সবাই আমাকে দূরে দূরে রাথতে শুরু করলো। সময়ের সাথে সাথে আমি একা হতে লাগলাম। দিনে দিনে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে নিলাম যখন দেখলাম, সমাজের ভদ্রলোকরা আমাকে এতো অবজ্ঞা, অবহেলা আর অপমান-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা করেও ক্ষান্ত হয়নি তারা, এখন আমার পরিবারের সবার উপর সেই অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে।
এরপর একসময় ঘরবন্দী জীবন শুরু করলাম, তাতেও শেষ রক্ষা হলো না আমার আর আমার পরিবারের। দিনে দিনে তোমাদের সমাজের অত্যাচার বারতেই থাকলো, আর আমার মনটা পাথরে রুপান্তরিত হতে লাগলো। কতরাত ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি আমার সাথে কেঁদেছে আকাশ বাতাস জীবজন্তু লতাপাতা, তবুও মন গলেনি সেই বিধাতার যিনি সৃষ্টি করেছেন আমায় তার অজান্তেই বড্ড অবহেলায়।
একসময় সৃষ্টিকর্তার সাথে বিদ্রোহ করতে আত্মহত্যা করার সিধান্ত নিলাম, কিন্তু জীবনের প্রতি তখনও কিছুটা মায়া ছিল। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম, বেড়িয়ে পড়লো দুচোখ যেদিক যায়, আল্লাহ’র দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও জায়গা হবেই। অন্তত আমার পরিবারের সদস্যরা কিছুটা লজ্জার হাত থেকে বাঁচবে।
যদিও দুজন মানুষ সারাজীবন চোখের জল ফেলবে। আজীবন আমার দুঃখী মা বাবা, আমাকে ক্ষমা করো, তোমরা। একদিন গভীর রাতে ঠিকই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।
আমার ঠাঁই হলো এই শাহবাগ এলাকায়, মাঝে অনেক কিছুই ঘটে গেছে সে কথা আর নাই বললাম। শুধু জীবনের প্রয়োজনে বা পেটের দায়ে নিজের বিবেক বিবেচনাকে বিসর্জন দিতে পারিনি, কতরাত কেটেছে অনাহারে তার কোন ইয়াত্বা নেই।
হাঁ আমি এখন ফুটপাতে বিছানা ছাড়াই ঘুমাই তাতে কোন দুঃখ নাই। এখানে কেউ আমাকে অতিরিক্ত বঞ্চনা দেয় না। একটু আর চোখে তাকিয়ে পথের মানুষ পথ বেয়েই চলে যায়। তবে আমার পেট চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইয়া আপুরা অনেকই আমার কাছে ফুল কিনে নেয়। তারা আমাকে অনেকই ভালোবাসে কারণ তারা বলে তুই অন্তত চাঁদাবাজি করিস না, তাই তোর কাছে ফুল কিনি, তোকে তো একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ।
আবার অনেক কপোত-কপোতী আসে আমার কাছে ফুল কিনতে, প্রথমে নিতে চায়না, তবে ২য় বার ঠিকই নেয়, কারণ আশেপাশে কোন ফুল যদি না পায় ঠিক তখনই ফুল কিনে নেয়, একপ্রকাশ বাধ্য হয়ে।
হঠাৎ একদিন আনমনে কলা ভবনের সামনে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর দুজন মানুষ আমার সামনে এলো,
আমাকে কেউ কোন নাম ধরে ডাকে না, সরাসরি বললো কিরে এভাবে মন খারাপ করে বসে আসিস কেন? আমি বললাম নাহ, কিছু না। ভাইয়াটা নাছোরবান্দা, সে আমাকে অনেক স্নেহ করেন, জোর করে বললো তুই তো চুপচাপ থাকার মানুষ টা, আমাকে নিয়ে মানুষ শব্দ টা উচ্চারণ করার পর আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কারণ আমাকে মানুষ শব্দ ব্যবহার করে কেউ ডাকে না।
আমাকে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আরো বেশি জোর করে বললো, সত্যি করে বলতো তোর কি হয়েছে? আমি তখন বলতে বাধ্য হলাম। বেশ কিছু দিন হলো ফুল বিক্রি তেমন হয়না, চারপাশে কি সব হট্রোগোল হচ্ছে, কেউ ফুল কিনছে না, তাই আমার রুটিরুজি তেমন নাই, তাই খাওয়া দাওয়া তেমন নেই, কি যে করি। আমার সাথে মন খারাপ করে ভাইয়াটাও বলে উঠলো হাঁ রে আমারও বুঝি তোর কাছ থেকে শেষ বারের মত ফুল কেনা, তোর কাছ থেকো প্রতিদিনই ফুল কিনি, বলেই আমার হাত থেকে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে তার মেয়ে বন্ধু টাকে দিয়ে বললো, শুনো কাল থেকে আর তুমি ক্যম্পাসে আসবে না।
মেয়েটি প্রতিবাদী হয়ে বলে ফেললো, কেন আসবো না, ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। আর আমি ঘরে বসে থাকবো ভাবলে কি করে, ভাইয়া টা ধমকের সূরে মেয়ে টা কে বলে উঠলো, তুমি বেশি বুঝো না, তুমি মেয়ে মানুষ এই আন্দোলন তুমি কি বুঝে। কাল থেকে ঘরের বাইরে বেড় হবে না।
মেয়ে টা আরো বেশি প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো, কেন ঘরে থাকবো, আমি কি মেয়ে বলে মানুষ না, আমি কি বাঙালি নাহ, আমি কি মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলি না। যদি আমি বাংলায় কথা বলি আমার মায়ের ভাষায় কথা বলি, তাহলে আমার মুখের ভাষা কেড়ে নেবার জন্য পাকিস্তানি হায়েনা শিয়ালের দলে মুখে শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু থাকতে তাদের রুখে দাঁড়াবোই, তুমি বাঁধা দিতে পারো না, তুমি যদি আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে পারো তবে আমিও ঝাপিয়ে পড়তে এতোটুকুও পিছপা হবো না বলে রাখলাম।
একসময় ভাইয়া টা আপুটার মনে জোর বুঝতে পেড়ে আর তর্কে জরালো না। আমি মাঝখান থেকে বলে উঠলাম। আচ্ছা ভাইয়া, আমি কি আপনাদের সাথে আন্দোলনে যেতে পারবো না,?
হঠাৎ ভাইয়া আমাকে বলে উঠলো তুই কেন আন্দোলনে যাবি, তোর জন্য আন্দোলন না, তুই তো একটা (…..?)
কথাটা শুনতেই আমার মনটা বিষাদে ভরে গেলো! তখন আপুটা আমার হাত ধরে বললো, তুই কেন আন্দোলনে যেতে পারবি না। অবশ্যই যাবি, আমি মেয়ে হয়ে যেতে পারলে তুইও যেতে পারবি, তুইও তোর মায়ের ভাষায় কথা বলিস, তোর ভাষা যাঁরা কেরে নিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে তুই প্রতিবাদ করবি, আন্দোলন সংগ্রামে ফেঁটে পরবি,মনে রাখিস, তুই আমাদের মত মানুষ, আমি তোর সঙ্গে আছি। নিজের অজান্তেই আমার চোখের কোণে অশ্রু কণা জমে উঠেছে গেলো, আপুটা পরোম মমতায় আমার চোখের জল মুছে দিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো বাংলার সৈনিক তৈরি থাক, সময় এলেই ডাক আসবে আন্দোলনের, তখন ঠিকই ঝাপিয়ে পড়বি, এতটুকুও কালক্ষেপণ করবি না। আমাদের মায়ের ভাষা আমাদের সবাই মিলে রক্ষা করতেই হবে।
আজ বিদায়, তৈরি থাকিস ডাক আসবে খুব তারাতাড়ি, মনে রাখিস তুইও মানুষ, তোমার মাকে তোকেও রক্ষা করতে হবে! এটা তোর দায়িত্ব। ভুলে যাস না, তুইও কোন বাঙালি মায়ের সন্তান। দেখতে দেখতে তারা রাস্তার সাথে মিশে গেলো, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম।
আমার হাতের ফুল গুলো সব আমারী চোখের পানিতে ভিজে গেছে। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হলো যে, অনেক দিন পর অশ্রু তে আমার চোখ ভিজেছে, আর এ অশ্রু আগের অনেক দুঃখ আর বঞ্চনার নয়। এই অশ্রু আমার বড্ড আনন্দের।
অতঃপর আমার অপেক্ষার পালা শেষ হলো, দেখলাম শাহবাগ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের সব জায়গায় মানুষের ঢল নেমেছে। বিক্ষোভে ফেঠে উঠেছে মানুষ, স্লোগান স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে এই বাংলার আকাশ বাতাস জীবজন্তু লতাপাতা। এবার আমার পালা আন্দোলনে যাবার, জীবনে তো আমাকে দিয়ে কিছু হয়নি, এটাই মোক্ষম সময় নিজেকে প্রামাণ করার আমার মায়ের ভাষা রক্ষা করার। আমার হাতের ফুল গুলো ফেলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আশা মিছিলের অগ্রভাগে মুষ্টিবদ্ধ হাতে। স্লোগান দিতে লাগলাম।
“রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই, বাংলা চাই। আমাদের দাবি, আমাদের দাবি, মানতে হবে মানতে হবে।
মায়ের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ছাড়া, অন্য কিছু মানবো না, মানবো না।”
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে যখন স্লোগান স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ হানাদার বাহিনীর বুলেটের বৃষ্টি শুরু হলো, আমার আশেপাশের অনেকের বুকে বুলেটের আঘাতে স্ফুলিঙ্গের মতো তাজা রক্তে রাজপথ লাল রক্ত ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ পিছপা হচ্ছে না। শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর স্লোগান দিচ্ছে- রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই, বাংলা চাই।
হঠাৎ শত্রুর ছোড়া একটা বুলেট আমার কপালে চুমু এঁকে দিলো, কান্না আমার ভাষা নয়, বাংলা আমার ভাষা! বুকের রক্ত বিলিয়ে দেওয়া আমার জীবনের একমাত্র পাওয়া। আমি শেষ বার বলে উঠলাম, “রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই, বাংলাাাা এএএএ চাই!”
কবি-সু-চয়নিকা (ট্রান্সজেন্ডার)