নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, বিবেক আর পেশাগত আচরণের বেড়াজালে বন্দি শিক্ষকদের চাহিদা, আবেগ, ভালবাসা – ভাললাগা, পেটে ক্ষুধা, পকেট খালি, সব – সময় অভাব – অনটন, উঠতে – বসতে, চলতে – ফিরতে নিত্যদিনের টানাপোড়েন এত কিছুর পরও ভাল থাকার অভিনয় করতে করতেই একজন শিক্ষকের জীবনের সব শেষ হয়ে যায়। তবু নিয়ম মেনে বিদ্যালয়ে যথাসময়ে যাওয়া, রুটিন ক্লাস, প্রক্সি ক্লাস, স্টাফ মিটিং, শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ, অভিভাবকদের, ম্যানেজিং কমিটির সাথে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় খোশমেজাজে সব আলাপ সেরে ক্লান্তদেহে বাড়িতে ফিরে আসার পর বাড়ির গিন্নীর খাবার পরিবেশনের পরিবর্তে এটা নেই, ওটা আননি কেন? কিসের মাস্টারি করো? মেয়েটার এটা চাই, ছেলেটার ওটা চাই, ছেলে – মেয়েদের কোচিং – বিদ্যালয় খরচ, অমুক বাড়ির দাওয়াত, এরুপ ফর্দ হাজির। কষ্টেশিষ্টে খুব গুরুত্বপূর্ণ ২/৩ টি দাবি পূরণ করলেই পকেট খালি। বাকীদিনগুলো হয় মহাজনদের নিকট থেকে সুদে টাকা নিয়ে অথবা ধার দেনা করে চলতে হয়।
পরের মাসে বেতন দিয়ে ঐ মহাজনের সুদসমেত টাকা ফেরত দিতেই পকেট খালি। আবার সুদে টাকা নেওয়া। এইভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ করে ঐ শিক্ষক মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন একসময়ের স্বনামধন্য শিক্ষকটিও। এরপরে শুরু হয় ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী কর্তৃক ঐ শিক্ষককে অবহেলা। এভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় একসময়ের তুখোড় একজন শিক্ষকের জীবন।
আর্থিক সংকট কেড়ে নিয়ে যায় তার আদর্শ, মেধা, সৃজনশীলতা। নষ্ট করে দেয় একটা সমাজের তুখোড় জ্ঞানভান্ডারকে, একটা পরিবারকে।
এটাই বাস্তবতা। এটাই আজকের জাতির বিবেকদের প্রকৃত অবস্থা।
শিক্ষক সম্মেলনে দাওয়াতি পন্ডিতেরা এসে শিক্ষকদের উপদেশ দিতে শুরু করেন। এটা মহান পেশা, জমিদারদের শখের পেশা।
যারা এসব উপদেশ বাণী শুনান তাদের বলি, আগে মোট জনসংখ্যার ৫-৬% মানুষ লেখাপড়া করত। যারা শিক্ষকতা করত তারা জমিদার পরিবারের। শখের বশে সময় কাটাতে এখানে আসত। কিন্তু আজ শিক্ষাটা শখের বস্তু নয়, এটা একটা শিশুর বাধ্যতামূলক কাজ এবং মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এখন শখ নয় সারাদেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করছে ৬-৭ লক্ষ শিক্ষক। প্রতিদিন একজন শিক্ষক গড়ে ৬৫০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা একটা বিশাল শ্রম। এই শ্রমটি সাধারণ শ্রমিক বা সমালোচনাকারী পন্ডিত বা এসিতে বসা জ্ঞানপাপীরা শিক্ষকদের এই শ্রমকে মূল্যায়ণ করার ক্ষমতা রাখেন কি??
অথচ অমানুষিক খাটুনি খাটার পর একজন শিক্ষককে নামেমাত্র অনুদান তুলে দেওয়া হয় মাস গেলে।
অথচ স্থানীয়, জাতীয়সহ প্রায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে সরকারকে সাহায্য করেন আমাদের শিক্ষক সমাজ।
কথায় আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। আপনি পরিশ্রম করাবেন কিন্তু পারিশ্রমিক দিবেননা ঠিকমত, এটা কেমন কথা। এর নাম জুলুম।
শিক্ষকদের জুলুম করবেন আবার তাদের নিকট থেকে ১০০% ফলাফল আশা করবেন এটা কেমন কথা??
আমরা আপনাদের কতটুকু বাধ্য শ্রমিক ভাবুন??
প্রত্যেক বেসরকারি শিক্ষকের মনে অসন্তোষ থাকলেও তারা আপনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেনা, কারণ তারা বিশ্বাস করে আপনারা তাদের মনের আশা পূরণ করবেন।
একটা ছোট্ট বাস্তবতা বলি, শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করলে সমস্ত দালান নেতা বাতাসের মতো উড়ে যাবে একসেকেন্ডেই।
তবে আমরা তো লাঠিয়াল হতে চাইনা। আমরা হতে চাই প্রকৃত শিক্ষক। জাতি যাদের দিকে চেয়ে আছে তাদের সন্তানদের পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, আদর্শ মানুষ হিসেবে তাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে, সুস্থ নাগরিক হিসেবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে – সেই শিক্ষকরা কেন লাঠি নিয়ে নামতে হবে রাস্তায়, কেন কাদঁতে হবে রাজপথে পড়ে, কেন পুলিশের সাথে মারামারি করতে যাবে জাতির বিবেকরা???
আর যদি রাজপথে যেতেই হয় তখন এ লজ্জা হবে কার?? শিক্ষকদের??? না সরকারের????
কত অসহায় আমাদের এই শিক্ষক সমাজ !! যারা এই শিক্ষকদের কল্যাণে ঐসব দামী চেয়ারে বসে কোর্মা – পোলাও খাও আর শিক্ষকদের দাবীর বিরুদ্ধে সরকারকে বুঝাও তোমাদের বুঝা উচিত আমরাই তোমাদের যত্ন করে পড়াশোনা করিয়ে ঐখানে পাঠিয়েছি।
তোমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হউক, শিক্ষক ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও।
তোমরা সরকারের কাছে থাক, মন্ত্রণালয়ে কাজ করো, তোমরা ইচ্ছে করলেই প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝাতে পার। প্রদীপ কুমার দেবনাথ, সহকারী প্রধান শিক্ষক , ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম বিভাগ।