তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিবেদক: দেশের বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ‘আফ্রিকান টিকওক’ ৯২ বছর জীবন্ত থাকার পর মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশে এ প্রজাতির বৃক্ষ শুধু মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ছিল। বনবিভাগ বলছে, গাছটি মারা যাওয়ায় এ প্রজাতির বৃক্ষও দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
বনবিভাগের বরাত দিয়ে জানা যায়, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষের মধ্যে ‘আফ্রিকান টিকওক’ প্রজাতির বৃক্ষ ছিল একটি। এ জাতীয় দুটি বিশাল বৃক্ষের অবস্থান ছিল লাউয়াছড়া বনে। এ প্রজাতির বৃক্ষ আর কোনো বনে নেই। ২০০৬ সালে ঝড়ে একটি বৃক্ষ উপড়ে পড়ে যাবার পর টিকে ছিল এই একটি। প্রায় ৯২ বছর পর চিরসবুজ গাছটির পাতা ঝরতে শুরু করে। বৃক্ষের গোড়ায় দেখা দেয় পচন। বর্তমানে গাছটিতে কোনো পাতা নেই। মরা ডাল দেখা যাচ্ছে। গোড়ায় পচন রয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, প্রাচীন এ বৃক্ষটি মারা গেছে।
লাউয়াছড়া বন বিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বর্তমান বৃষ্টি মৌসুমে প্রায় ১০০ ফিট উচ্চতা ও ১২ ফিট গোলাকারের বিরল প্রজাতির ‘আফ্রিকান টিকওক’ গাছের পাতা সম্প্রতি ঝরে গাছটির গোড়ায় পচন ধরেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গাছটি মারা গেছে।
বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মোট দুটি আফ্রিকান টিকওক বৃক্ষ ছিল। দুটি বৃক্ষের মধ্যে ২০০৬ সালে ঝড়ে একটি উপড়ে পড়ে। একমাত্র যে গাছটি উদ্যানে ছিল সেটিরও পাতা ঝরে পড়া এবং গোড়ায় পচন দেখে বিষয়টি বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনিস্টিউটকে (বিএফআরআই) অবগত করা হয়েছে। বৃক্ষটির বয়স সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই বনবিভাগের কাছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বৃক্ষটির বয়স ৯০-৯২ বছর হবে।
বনবিভাগের সিলভিকালচার টিচার্স বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বহু চেষ্টা করেও বৃক্ষটি থেকে কোনো বংশবিস্তার করা সম্ভব হয়নি। কারণ ‘আফ্রিকান টিকওক’ বৃক্ষটির কোনো বিচি ছিল না। ফুল ধরলেও ঝরে পড়ে যেতো। কয়েক বছর পূর্বে ওই বৃক্ষটি থেকে কাটিং সংগ্রহ করা হলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৩০ সালে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা কমলগঞ্জে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আসেন। তখন প্রাকৃতিক এ সংরক্ষিত বনের অধিকাংশ গাছ কেটে কৃত্রিমভাবে চাপালিশ, সেগুন, গর্জন, লোহাকাট, রক্তনসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের চারা রোপন করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এসব বৃক্ষের মধ্যে আফ্রিকান টিকওকের দুটি চারাও ছিল। বাংলাদেশের একমাত্র আফ্রিকান টিকওক বৃক্ষটি স্থানীয়দের কাছে ‘অজ্ঞান গাছ’ হিসেবে পরিচিত। লোকমুখে শোনা গেছে, এই বৃক্ষের পাশ দিয়ে কোনো পথচারি হেঁটে গেলে বা বৃক্ষের নিচে দাঁড়ালে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। এ নিয়ে নিকট অতীতে সংবাদপত্রের শিরোনাম হলেও এর কোনো সত্যতা মিলেনি। তবে এক বৃক্ষ গবেষণায় দেখা গেছে, এই বৃক্ষে কার্বনিক অ্যাসিড ও ক্লোরোফর্মের উপস্থিতি রয়েছে। এ কারণে বৃক্ষটির পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে অনেকেরই একটু ঘুম ঘুম ভাব তৈরি হতে পারে। আবার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নাক ও গলা জ্বলা এবং হাঁপানির সম্ভাবনাও বিদ্যমান।
বন বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, আফ্রিকান টিকওক প্রজাতির ক্লোফোরা এক্সেলসা (সাধারণত আফ্রিকান টাক, মভিলে বা ইরোকো নামে পরিচিত) ক্রান্তীয় আফ্রিকার একটি বৃক্ষ। এ জাতীয় বৃক্ষ আফ্রিকা মহাদেশের অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গিনি, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, ঘানা, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, মালাউই, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডাসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এর প্রাকৃতিক বাসস্থান রেইন ফরেস্ট চিরহরিৎ বনে। বর্তমানে এই প্রজাতিটি আদি জন্মভূমি আফ্রিকাতেই রয়েছে চরম ঝুঁকির মুখে। আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে আফ্রিকান টিকওকথ বৃক্ষকে আফ্রিকান ওক, আবেং, আলা, বঙ্গ, বাঙ্গি, বাঙ্গু, ডেইডি, ইরোকো, কাম্বালা, মকুকো, মুরিতুলুল্ডা, মুউলে, মউউল, নোংন্ড, ওডুম, টুলে, উলোকো, লোকো, এমএসুল, মালালা, অজিজ, রোক, সিঙ্গা নামে ডাকা হয়।
দেশে একমাত্র লাউয়াছড়া বনের সারি সারি বিশাল আকৃতির নানা প্রজাতির বৃক্ষের মধ্যে বন বিট কার্যালয়ের সামনেই এতোদিন এ জাতীয় বৃক্ষটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আফ্রিকান টিকওক বৃক্ষটি মারা যাওয়ায় দেশ থেকে এ প্রজাতির বৃক্ষও বিলুপ্ত হয়ে গেল। মারা যাওয়া বৃক্ষটি হাজারো বৃক্ষের ভীড়ে বর্তমানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের এই দেশের একমাত্র বিরল ঠিক ওক বৃক্ষটি।